আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলা ৬ আসামির মৃত্যুদ- বহাল ৭ জনের যাবজ্জীবন
এস এম নূর মোহাম্মদ : গাজীপুর-২ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় ছয় আসমির মৃত্যুদ- ও দুজনের যাবজ্জীবন বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। এছাড়া সাজা কমেছে সাতজনের। এছাড়া খালাস পেয়েছেন ১১জন। গতকাল বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। এর আগে সর্বশেষ গত ৮ জুন ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিলের উপর শুনানি শেষে রায়ের জন্য গতকাল দিন ঠিক করে দিয়েছিলেন আদালত। এদিকে রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে জাহিদ আহসান রাসেল সাংবাদিকদের বলেন, রায়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। তিনি বলেন, অনেককে খালাস দেওয়া হয়েছে, অনেকের সাজা কমানো হয়েছে। তাই পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে খালাস এবং দ- কমানোর বিরুদ্ধে আপিল করবো। আশা করি, আপিল বিভাগে ন্যায় বিচার পাবো।
অপরদিকে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি নুরুল ইসলাম সরকারকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন তার ভাই সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হাসান উদ্দিন সরকার। তিনি বলেন, আমরা সুবিচার পাইনি। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাব। আশা করি, সেখানে সুবিচার পাবো।
গতকাল রায় ঘোষণার জন্য দুপুর ১টার দিকে এজলাসে আসেন দুই বিচারপতি। এর আগেই গণমাধ্যম কর্মী, আইনজীবী এবং দর্শনার্থীতে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল আদালত। আর সকাল থেকেই রায়ের জন্য আদালতের বাইরে অবস্থান করতে থাকে গাজীপুর থেকে আসা আওয়ামী লীগের কয়েকশ’ নেতাকর্মী। চেয়ারে বসেই বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, বিচারপ্রার্থী এবং সবার সুবিধার্থে আমরা এ রায়টি বাংলায় বলব। এটি লিখেছেন আমার বোন মাননীয় বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ। আমি তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছি। আর আমি প্রথমেই রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরব। পরে মাননীয় বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ মূল রায়টি ঘোষণা করবেন।
বুধবার হাইকোর্টের রায়ে নিম্ন আদালতের দেওয়া মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয় ছয় আসামির। ওই ছয়জন হলেন নুরুল ইসলাম সরকার, নুরুল ইসলাম দিপু (পলাতক), মাহবুবুর রহমান মাহবুব, শহীদুল ইসলাম শিপু (পলাতক), হাফিজ ওরফে কানা হাফিজ (পলাতক), সোহাগ ওরফে সরু।
মৃত্যুদ- থেকে সাত আসামির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। ওই সাতজন হলেনÑ মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ আহমেদ হোসেন মজনু (পলাতক), আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু (পলাতক), রতন মিয়া ওরফে বড় মিয়া (পলাতক), জাহাঙ্গীর (পলাতক), মশিউর রহমান ওরফে মশু (পলাতক), আবু সালাম ওরফে সালাম (পলাতক)। এছাড়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত নুরুল আমিনের আপিল নামঞ্জুর করে সাজা বহাল রাখা হয়। আর পলাতক আসামি অহিদুল ইসলাম টিপু আপিল করেননি। তাই যাবজ্জীবন সাজাই বহাল রাখেন আদালত।
এদিকে মৃত্যুদ- প্রাপ্ত আসামি ছোট রতন ও আল আমিন মারা যাওয়ায় তাদের বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন হাইকোর্ট।
অন্যদিকে নি¤œ আদালতে মৃত্যুদ- পাওয়া আমির হোসেন, জাহাঙ্গীর ওরফে বড় জাহাঙ্গীর, ফয়সাল (পলাতক), লোকমান হোসেন ওরফে বুলু (পলাতক), রনি মিয়া ওরফে রনি ফকির (পলাতক), খোকন (পলাতক) ও দুলাল মিয়াকে (পলাতক) খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। এছাড়া যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত রাকিব উদ্দিন সরকার ওরফে পাপ্পু, আইয়ুব আলী, জাহাঙ্গীর- পিতা মেহের আলী ও মনিরকেও খালাস দিয়েছেন আদালত।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ২০০৪ সালের ৭ মে টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক সমাবেশে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় আহসান উল্লাহ মাস্টারকে। ঘটনার পরদিন নিহতের ভাই মতিউর রহমান মতি বাদী হয়ে টঙ্গী থানায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের পুত্র নামে পরিচিত জাতীয় ছাত্রসমাজের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম দীপুকে। এ ছাড়া এজাহারে যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় শিল্পবিষয়ক সম্পাদক নূরুল ইসলাম সরকারকে হত্যাকা-ের পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. খালেকুজ্জামান প্রায় দুই মাস তদন্ত শেষে ৩০ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। এই মামলায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নুরুদ্দিন ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন। রায়ে প্রধান আসামি নূরুল ইসলাম দীপু ও যুবদল নেতা নূরুল ইসলাম সরকারসহ ২২ জনকে মৃত্যুদ- এবং ছয় জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন। আর দুজনকে খালাস দেওয়া হয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে দ-প্রাপ্তরা হাইকার্টে আপিল করে। অপরদিকে মৃত্যুদ- অনুমোদনের জন্য মামলার নথিপত্র আসে হাইকোর্টে। ২০০৯ সালের নভেম্বর আপিলের শুনানি শুরু হয়। তিনদিন শুনানির পর আপিলটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। পরে বিচারপতি আবু তারিক ও বিচারপতি মো. আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে শুনানি চলাকালে ২০১০ সালের ৭ জুলাই আপিলটি তৎকালীন প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো হয়। এভাবে পার হয়ে যায় প্রায় সাত বছর। অবশেষে চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের বেঞ্চে এই মামলার শুনানি শুরু হয়।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বসির আহমেদ ও রোনা নাহরীন। বাদীপক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এম. আমীর উল ইসলাম, আবদুল মতিন খসরু প্রমুখ। অপরদিকে আসামিপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন সাবেক বিচারপতি টিএইচ খান, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এম মাসুদ রানা। সম্পাদনা: সৈয়দ নূর-ই-আলম