কেন নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশি হিন্দুদের নিরাপত্তা দেবেন?
রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী : ইসলামি চরমপন্থা এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশের শতশত হিন্দু পরিবার অন্যান্য দেশে পালিয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় এবং সামাজিক অবস্থানের কারণে ক্ষমতাসীন দল, চক্র এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার পরিবর্তে অপরাধীদের রক্ষা করার চেষ্টা করে। তারা বাংলাদেশের চিরচরিত ঐতিহ্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বুলি উচ্চারণ করেই ক্ষান্ত থাকে।
এটি গত চার বছরে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনার চিত্র। সংখ্যালঘু ধর্মীয়গোষ্ঠী বিশেষত হিন্দুরা প্রতিটি ক্ষেত্রে অমর্যাদা, অসম্মান, সামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সমতা এবং ন্যায়বিচার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। মানবাধিকার এবং সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সন্ত্রাস, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। মন্দির এবং পূজার স্থানে ভাঙচুর এবং জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করার ঘটনা ঘটেছে। তাদের জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এবং তাদের জোরপূবর্ক ভারতে ‘রাষ্ট্রহীন নাগরিক’ হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের সংখ্যা গত ৬ বছরে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ১৯৪৭ সালে যে সংখ্যা ছিল ২৮ ভাগ ২০১১ সালে তার পরিমাণ ৯ ভাগ। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশে হিন্দুরা সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক খাতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় তাদের নিরাপত্তার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে প্রার্থনা করছে। তাদের প্রতি আমার বিনীত নিবেদন, কেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শুধুমাত্র বাংলাদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন?
দুই সরকারের মধ্যে কি কোনো সামাজিক-অর্থনৈতিক চুক্তি বা সমঝোতা হয়েছে?
১৯৫০ সালে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিয়ে নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু এর কোনো বাস্তবসম্মত ফল পাওয়া যায়নি। এই চুক্তি এখনও আছে, কিন্তু এটি কি বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিম্নমুখিতা দিয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে? ১৯৭১ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে ভারতের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং বৈধতার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ছিল। দুই দেশের মধ্যে কোনো সংলাপ ছাড়াই স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হলো।
সুতরাং বাংলাদেশে আমাদের টিকে থাকার জন্য কৌশল খুঁজে বের করা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু ভারত এই ইস্যুগুলোতে কোনো উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করছে না। বরং ভারতের মনোযোগ বাণিজ্য, ট্রানজিট এবং পরিবহনের দিকে। তারা এগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখছে।
বাংলাদেশের সকল সম্প্রদায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাগরিক। তাহলে কেন তারা ভারতীয় হস্তক্ষেপ চাইছে? এটি কি নিজ দেশের প্রতি আস্থার অভাব নয়? ভারত বাংলাদেশের মধ্যে সংখ্যালঘুদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে বলা দরকার। আমরা জানি বাংলাদেশ বিচ্ছিন্নতাবাদের একটি দেশ। শতাব্দীর মধ্যে চারবার তার পরিচয় পরিবর্তিত হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জনগণের নীতি-নিয়ম বারবার পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ এবং ধর্ম যুক্তিগতভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ঐতিহ্যগত প্রচলিত এবং সুশৃঙ্খল নীতিতে উভয়ের ভূমিকা হারিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতার জন্য লোভ, প্রতিহিংসার রাজনীতি, পরাজয়ের ভয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে।
১৯৭১ সালের চিত্র ছিল ভিন্ন। বাংলাদেশের মিলিয়ন মানুষকে রক্ষার্থে ও মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে তারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। এটি অত্যন্ত আনন্দদায়ক ইতিহাস। কিন্তু এর পর ভারত কখনও-ই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেনি, বরং বাংলাদেশের সীমান্তের রাষ্ট্রহীন বাংলাদেশি নাগরিকদের ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করেছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে গত ৬৮ বছরে দেশটি থেকে ১ কোটির মতো হিন্দু দারিদ্রতা, নিপীড়ন, ঘূর্ণিঝড় নিরাপত্তাহীনতার কারণে ভারতে পালিয়ে এসেছে। বাংলাদেশে আজ হিন্দুর সংখ্যা ১০ ভাগ কমে গিয়েছে। ২০৫০ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানের পর্যায়ে পৌঁছে যাবে, কারণ তখন কোনো হিন্দু মানুষ বাংলাদেশে থাকবে না।
লেখক : ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সচিবালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা লেখক, কলামিস্ট এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু মানবাধিকার কংগ্রেসের মহাসচিব।
শ্রীলঙ্কার এশিয়ান ট্রিবিউনে লেখাটির নির্বাচিত অংশ অনুবাদ : লিহান লিমা