প্রকৃতির ফিরিয়ে দেয়ার গল্প…
সোনিয়া জান্নাত: ‘ন্যাচারাল ল অভ রিটার্ন’ বলে ইংরেজীতে একটি কথা আছে। অর্থাৎ আপনি যা করবেন, তা একদিন ফেরত পাবেন।
সে রাতে ফিলাডেলফিয়াতে প্রচন্ড ঝড় উঠেছিলো, মুষলধারে টানা বৃষ্টিও ঝরছিলো। মধ্য বয়স্ক মানুষটি এই ঝড়ের রাত্রে স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় আশ্রয় নেবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। বহুক্ষণ খোজাখুঁজির পর ছোট্ট একটা হোটেলের সন্ধান পাওয়া গেলো।
রিসেপশনে গিয়ে রুম পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই হোটেলের তরুণ ম্যানেজার মাথা নেড়ে না করতে গিয়েও কিছুক্ষণ সময় নিলো। তারপর মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটিয়ে মধ্যবয়স্ক দম্পতির দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলোÑ‘স্যার, আমাদের সব ক’টি রুম ইতোমধ্যেই বুকড হয়ে গেছে। কিন্তু এত চমৎকার একটি দম্পতিকে এই ঝড়ের রাতে বাইরেও যেতে দিতে পারিনা। যদি আপত্তি না থাকে আপনারা আমার রুমে রাতটা কাটাতে পারেন। রুমটা হয়তো পছন্দ হবেনা, কিন্তু রাতটা কাটানোর জন্য একেবারে মন্দও নয়!’
ম্যানেজার কোথায় ঘুমাবে ভেবে স্বামী ভদ্রলোকটি রাজী হলেন না। কারণ তিনি চাইছিলেন না তাদের তাদের জন্য কেউ বিড়ম্বনার শিকার হন। এবার নিজ থেকেই তরুণ ম্যানেজারটি তাকে আশ্বস্ত করলো, তার জন্য দুশ্চিন্তা করতে হবেনা।
সে কোনো সমস্যা ছাড়াই রিসিপশনে বসে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারবে। এবার স্বামী-স্ত্রী দুজনই রাজী হলেন। পরদিন সকালে বিল দেয়ার সময় স্বামী ভদ্রলোকটি ম্যানেজার কে বললেন, ‘তোমার মত একজন ম্যানেজারের সবচেয়ে ভাল একটি হোটেলের বস হওয়া উচিৎ। একদিন আমিই হয়তো তোমার জন্য সেই হোটেল টা বানাবো।’
তরুণ ম্যানেজার ভদ্রলোকটির দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করলো। সে হাসিতে স্বামী-স্ত্রীও যোগ দিলো। তিনজন মিলে বেশ একচোট হাসির পর্ব শেষ করে স্বামী-স্ত্রী বিদায় নিলেন।
এরপর দুই বছর পার হয়ে গেছে। হোটেলের ম্যানেজার সেই ঝড়ের রাতে তার রুমে রাত কাটানো সেই দম্পতির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো। ম্যানেজারের ঠিকানায় একটি চিঠি আসলো। চিঠির মধ্যে রিটার্ন টিকেট সহ নিউইয়র্কগামী প্লেনের একটি টিকেট। চিঠিটি লিখেছেন সেই ভদ্রলোক। যিনি ঝড়ের রাতে নিরুপায় হয়ে ফিলাডেলফিয়ার ছোট্ট হোটেলটিতে আশ্রয় নিয়েছিলো। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ঝড়ো রাতের উপকারের কথা তিনি ভোলেন নি। যদি সম্ভব হয়, ম্যানেজার যেন অবশ্যই নিউইয়র্কে তার সাথে একটু দেখা করে আসেন।
তরুণ ম্যানেজার ভাবলো, ব্যপারটা মন্দ নয় নিউইয়র্কের আলো বাতাসে কয়েকদিন ঘুরে আসা যাক। আর তাছাড়া বিপদে পড়া সেই চমৎকার দম্পতিটির কথা মনে হতেই তাদের প্রতি সে এক তীব্র আকর্ষণ বোধ করলো।
প্লেন থেকে নামতেই ভদ্রলোকটি তাকে রিসিভ করলেন। তারপর গাড়িতে করে নিউইয়র্কের ফিফথ এভিনিউ এর থার্টি ফোর্থ স্ট্রিটে সদ্য গজিয়ে ওঠা ঝকঝকে বিশাল এক বিল্ডিংয়ের দিকে আঙুল তুলে ভদ্রলোক বললেন, ‘এটাই সেই হোটেল যেটা আমি তোমার বস হবার জন্য বানিয়েছি।’
– আপনি নিশ্চয়ই মজা করছেন! তরুণ ম্যানেজার হতভম্ব। বাকরুদ্ধ!
– নিশ্চিত থাকো ইয়াং ম্যান, আমি মজা করছিনা। ভদ্রলোকের মুখে আতœবিশ্বাসের হাসি।
…ভদ্রলোকটি ছিলেন উইলিয়াম ওয়ালডর্ফ এ্যাস্টার, এবং সেই ঝকঝকে বিল্ডিংটিই আজকের সেই বিখ্যাত ওয়ালডর্ফ-এ্যাস্টরিয়া হোটেল। ১৮৯৩ সালে তৈরী করা এই হোটেলটি নিউইয়র্কের প্রথম দিকের সুউচ্চ স্থাপনা। হ্যানরি জে হারডেনবার্গ এর নকশা করেছিলেন। যা আজও তার ভাবগাম্ভির্য ধরে রেখেছে স্বমহিমায়।
সেই তরুণ ম্যানেজার কখনো কল্পনাও করেনি সে রাতের ছোট্ট ওইটুকু উপকার তাকে মামুলি এক ছোট্ট হোটেলের ম্যানেজার থেকে পৃথিবীর গ্ল্যামারাস হোটেল গুলোর একটার ম্যানেজার বানিয়ে দেবে!
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, আজকাল কাউকে উপকার করলে প্রতিদানে অপকার টাই ভাগ্যে বেশি মিলে। তারপরও, কেউ মনে রাখুক আর না রাখুক, প্রকৃতি ঠিকই মনে রাখে এবং একদিন ঠিকই মানুষের সব হিসাব কড়ায় গন্ডায় পরিশোধ করে দেয়। প্রকৃতির অমোঘ এই আইনটি নাকি এমনই।
(লেখিকার ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া)
সম্পাদনা: পরাগ মাঝি