ব্রহ্ম
ৎ বিনয় ভূষন জয়ধর
শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণের লীলা বিশেষ করে মানবীয় লীলা অতি নিগূঢ় বেদগুহ্য বলা চলে। আচার্য শঙ্করের মতো জ্ঞানীগুণী লোকও মাঝে মাঝে লীলাতত্ত্ব ব্যাখ্যাতে ভুল করে ফেলেন। আজকাল মুদ্রাযন্ত্রের অতি প্রচারে গভীর শ্লোকগুলো ও লীলারসিক মহাজনদের ভাবগর্ভ পদ পদাবলীগুলো অতি সাধারণ লোকের সহজপ্রাপ্য হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। এই ক্ষতি হতে রক্ষা পাবার উপায় যে কী তা সম্মুখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তবুও বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে লীলা আস্বাদনে প্রবৃত্ত হচ্ছি।
সর্বাগ্রে বোঝা প্রয়োজন, শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ ও তাঁর সখাসখীগণ মানুষ মূর্তিধারী হলেও আমাদের মতো মানুষ নয়। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং পরব্রহ্ম। ব্রহ্ম শব্দটি বৃংহ ধাতু হতে এসেছে। বৃংহ ধাতুর অর্থ বড় হওয়া, বড় করা। যিনি সবচেয়ে বড় তিনিই ব্রহ্ম। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, এই পরিদৃশ্যমান জগৎÑ এই সমস্তের মূল যিনি এবং যাতে অবস্থিত তিনি ব্রহ্ম। তিনি অন্য সকলের অপেক্ষা বড়। সকলের অপেক্ষায় সকল বিষয়ে সমধিক রূপে বড়। তার সমান কেউ নেই, তার অধিকও কেউ নেই। ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দ। ব্রহ্ম বস্তুটি মূলতঃ আনন্দই। সৎ চিৎ আনন্দের বিশেষণ। এই প্রাকৃত জগতের আনন্দের মতো সে আনন্দ ক্ষণভঙ্গুর অনিত্য নয়। এই আনন্দ চিৎচৈতন্যময় বস্তু; প্রাকৃত আনন্দের মতো জড়বস্তু নয়। সৎ শব্দ অস্তিত্ব-বোধিক, চিদানন্দ ব্রহ্মের উপাদান। উহা কেবল নিত্য নয়, চৈতন্যও। ব্রহ্ম রসস্বরূপ। রস অর্থ চমৎকারিত্ব। যে বস্তু আস্বাদনে প্রতিক্ষণেই চমৎকারিত্ব তাই ব্রহ্ম। রস বলিতে রস ও রসিক দুই-ই বোঝায়। রসের যেখানে পূর্ণতম বিকাশ তাকে বলে পরব্রহ্ম। পরব্রহ্মই শ্রীকৃষ্ণ। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ নিজ পরিচয় দিয়েছেন, ‘ব্রহ্মণো হি প্রতিষ্ঠাহম্’, অর্থাৎ আমি ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা। যেমন মনে করুন একটি উজ্জ্বল বস্তু এত উজ্জ্বল যে, উজ্জ্বলতার জন্য বস্তুটিকে দেখা যায় না। তখন যদি কেউ কাকেও বলে, ওই উজ্জ্বলতার প্রতিষ্ঠা ওই মণিটিতে। যদি এমন একটা চশমা লাগাও যাতে ওই উজ্জ্বলতা অনেক কমে যাবে, তাহলে মণিটিকে দেখা যাবে। অনেক জ্ঞানীজন আছেন যারা ব্রহ্ম বললে সহজেই বুঝতে পারেন কিন্তু কৃষ্ণ বললে বুঝতে পারেন না। তার কারণ জ্ঞানের চোখে ব্রহ্মের অশেষ জ্যোতিটা দৃষ্ট হয়, ভক্তির দৃষ্টিতে জ্যোতিটা কিছুটা কেটে যায়।
জ্যোতি ও ব্রহ্ম একই বস্তু। শ্রীকৃষ্ণ নিজের পরিচয় দিয়েছেন, ‘ব্রহ্মণো হি প্রতিষ্ঠাহম্’। উনি ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা। বৈষ্ণব আচার্যগণ সহজ ভাষায় বলেন, ব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণের অঙ্গজ্যোতি।
জ্যোতি বস্তুটা নিরাকার। যাহার জ্যোতি তিনি সাকার। এই জন্যই বলা হয়, পরব্রহ্ম নিরাকার এবং শ্রীকৃষ্ণ সাকার। শ্রীকৃষ্ণ পরাকৃতি, দ্বিভুজ, দ্বিপদ, এক মস্তক, দুই কর্ণ, দুই চক্ষু। শ্রীকৃষ্ণ লীলাময়। শিশুগণ যেরূপ খেলা করে, শ্রীকৃষ্ণের লীলাও সেরূপ; কোনোরূপ কার্যসিদ্ধির সংকল্প নেই। শ্রীকৃষ্ণ আনন্দের প্রেরণায় লীলা করেন। লীলা খেলা একাকী হয় না। খেলায় সঙ্গীদের বলা হয় পরিকর, খেলার স্থানকে বলা হয় ধাম। শ্রীকৃষ্ণ মাধুর্যের ভা-ার। মাধুর্য এত অধিক যে, সকলের চিত্ত আকর্ষণ করে। আকর্ষণ করার শক্তি অসীম বলেই শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয় ‘কৃষ্ণ’ (সর্বাকর্ষণকারী)।
শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্যের এমন একটি আকর্ষণীয় শক্তি আছে, তাতে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং আস্বাদন করতে চঞ্চল হন। নিজের মুখ নিজের দেখতে ইচ্ছা হলে দর্পণের প্রয়োজন হয়। সেরূপ শ্রীকৃষ্ণের নিজের সঙ্গে যে চিদ্দর্পণ আছে তার নাম যোগমায়া। যোগমায়া অঘটন-ঘটন-পটিয়সী। ইনি শ্রীকৃষ্ণের পরিকর, সকলকে মুগ্ধ করতে পারে না।
শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ সৎ, চিৎ, আনন্দ এই তিনটি শক্তি আছে। সৎ অংশের শক্তিকে বলে সন্ধিনী, চিৎ অংশকে বলে সংবিদ ও আনন্দ অংশকে বলা হয় হ্লাদিনী। হ্লাদিনী শক্তি আনন্দ সম্বন্ধীয় শক্তি। এটা দ্বারা ভগবান নিজেও আনন্দ অনুভব করেন ও অন্যকেও উপভোগ করান। শ্রীকৃষ্ণের সখা-সখীগণ সকলেই আনন্দঘন মূর্তি। শ্রীকৃষ্ণের করুণা ও ভক্ত-বাৎসল্য গুণ অফুরন্ত। তিনি নিজেকে ‘ভক্ত-পরাধীন’ বলে ঘোষণা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ ব্রজে চারভাবে লীলা আস্বাদন করেন। শ্রীকৃষ্ণের দাস্য রসের পরিকরদের নাম রক্তক, পত্রক ইত্যাদি। তাদের শ্রীকৃষ্ণের প্রতি মমত্ববুদ্ধি বশতঃ তারা দাসের মতো সেবা দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের প্রতিবিধান করেন। সখ্য রসের পরিকর সুদাম, মধুমঙ্গল প্রভৃতি। দাসগণ অপেক্ষা ইহাদের শ্রীকৃষ্ণের প্রতি মমত্ববুদ্ধি অধিক। বাৎসল্যে সখ্য অপেক্ষা মমত্ববুদ্ধি অধিক। নন্দ যশোদা প্রভৃতি বাৎসল্য রসের পরিকর। মধুর রসে বাৎসল্য রস অপেক্ষা মমত্ববুদ্ধি অধিক। রাধিকা প্রভৃতি সখিগণ মধুর রসের পরিকর। সকল পরিকরগণের মধ্যে শ্রীরাধিকার রূপ, গুণ ও মাধুর্য সর্বাধিক। শ্রীকৃষ্ণের রস আস্বাদন করিবার পরিপাটিও সর্বাধিক। পরিকরগণের সকলেরই উদ্দেশ্য শ্রীকৃষ্ণের সুখবিধান। তাদের আত্ম-সুখ-বাঞ্ছা বিন্দুমাত্র নেই। আত্মবলিদান বলিতে যা বুঝায় তা সকলই শ্রীকৃষ্ণের পদে সমর্পিত। শ্রীকৃষ্ণ ও তার পরিকরগণের সম্বন্ধে এরূপ জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম না করে শ্রীকৃষ্ণের লীলা আস্বাদনে প্রবেশ উচিত নয়।
লেখক : প্রকৌশলী