দুর্গম পাহাড়ে এনজিওর আড়ালে চলছে ধর্মান্তর করণ
মমিনুল ইসলাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফিরে : বাংলাদেশের পাহাড়ি জনপদ পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে এনজিওর আড়ালে চলছে ধর্মান্তর করণ। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ জনপদের পিছিয়ে থাকা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের টার্গেট করে মাঠে নেমেছে আন্তর্জাতিক খ্রিস্টান মিশনারিগুলো। অভিযোগ, স্বাস্থ্য ও সমাজসেবার নামে দারিদ্র্য পীড়িত উপজাতি জনগোষ্ঠীকে ধর্মান্তÍর করণের অপতৎপরতায় লিপ্ত বিদেশি অর্থে পরিপুষ্ট এ এনজিওগুলো। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম জোরদার হওয়ার শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে বসবাস করে ১৩টি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী। রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা, চরম দারিদ্র্য, ক্ষুধা, মহামারি, অপুষ্টি ও স্যানিটেশন সমস্যা নিত্যসঙ্গী তাদের। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করছে এনজিওগুলো। পশ্চিমাদের পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চক্রান্তের অংশ এটি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে সেখানে ১২ হাজার উপজাতি পরিবার খ্রিস্টান হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিন পার্বত্য জেলার ১৯৪টি গির্জা মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্যে খাগড়াছড়ি জেলায় ৭৩টি গির্জা রয়েছে। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এ জেলায় চার হাজার ৩১টি পরিবার খ্রিস্টান হয়েছে। বান্দরবান জেলায় গির্জা রয়েছে ১১৭টি। এখানে একই সময়ে খ্রিস্টান হয়েছে ছয় হাজার ৪৮০টি উপজাতি পরিবার।
রাঙ্গামাটিতে চারটি গির্জা খ্রিস্টান বানিয়েছে এক হাজার ৬৯০টি পরিবারকে। পাহাড়ি যেসব জনগোষ্ঠীর লোকসংখ্যা কম, তাদের প্রায় শতভাগ খ্রিস্টান হয়ে গেছে অনেক আগেই। এমন একটি উপজাতি পাংখু। যাদের পুরো জনগোষ্ঠীই খ্রিস্টান হয়ে গেছে; বদলে গেছে তাদের ভাষা। এমনকি তাদের অক্ষরও ইংরেজি।
জানা যায়, এনজিওর নাম ধারণ করে খ্রিষ্টানরা এই দুর্গম এলাকায় হাসপাতাল, বিনোদন কেন্দ্র, গির্জা ইত্যাদি গড়ে তুলেছে। বহুজাতিক কোম্পানির আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থে এবং অসহায়, নিঃস্ব, নিরক্ষর মানুষকে সেবা করার নামে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে এ এনজিওগুলো। এদের বাজেটের ৯০ শতাংশ অর্থ খ্রিস্টানদের বা খ্রিস্টান হওয়ার সম্ভাবনাময় ব্যক্তিদের স্বার্থে ব্যয় হয়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহত্তর ইউনিয়ন খাগড়াছড়ি জেলার সাজেক। সীমান্তবর্তী ও দুর্গম এই উপত্যকায় খাগড়াছড়ি বা রাঙ্গামাটি শহর থেকে পৌঁছতে সময় লাগে দু’দিন। এই ইউনিয়নের ২০টি গ্রামে খেয়াং, বম, পাংখু, লুসাই উপজাতির ১০ হাজার মানুষের বাস। ২০ বছর আগেও এখানে খ্রিস্ট ধর্মের নামগন্ধ ছিল না। উপজাতিদের ভাষা, সংস্কৃতি সবই ছিল। আজ তার কিছুই নেই।
সাজেক ইউনিয়নের আকর্ষণীয় রুইলুই পর্যটন কেন্দ্রে অবস্থিত গির্জার ধর্ম প্রচারক ময়তে লুসাইয়ের সঙ্গে কথা হয় এ বিষয়ে। তিনি আমাদের সময় ডটকমের কাছে ধর্মান্তর করণের বিষয়টি অস্বীকার করেন। বলেন, ‘আমরা কেবল নিজ ধর্মের অনুসারীদের বাইবেলের শিক্ষা দিয়ে থাকি।’
‘সেভেন সিস্টা’র নামে খ্যাত মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, হিমাচল, অরুণাচল প্রভৃতি ভারতীয় রাজ্যের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখন ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান। ওই সব পাহাড়ি অঞ্চলসংলগ্ন বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায়ও উল্লেখযোগ্য হারে খ্রিস্টানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রদায়িক উন্নয়ন পরিকল্পনার অধীনে এখানকার খ্রিস্টান যুবকদের উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি দেশে প্রেরণ করে থাকে। এভাবে সীমান্তের দুই পাশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
এদিকে, এনজিওদের দেশীয় সংস্কৃতি ও আদর্শবহির্ভূত সব কর্মকা- নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন সচেতন নাগরিকরা। পাশাপাশি এ এনজিওদের কর্মকা- ঘনিষ্টভাবে মনিটরিং এর দাবি তুলেছেন তারা। এর আগে ২০১৫ সালের জুন মাসে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা পরিষদের হলরুমে ধর্মান্তরিত করার ঘটনায় গণশুনানিও অনুষ্ঠিত হয়। তারও আগে ২০১৪ সালের ৮ ডিসেম্বর উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টান মিশনারীদের বিরুদ্ধে ধর্মান্তর করণের অভিযোগ এনেছে বান্দরবানের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাক সম্প্রদায়ের নেতারা। এ বিষয়ে ২০১৪ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে একটি স্মারকলিপিও প্রদান করেন তারা।
৩২ জন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নেতার স্বাক্ষরিত স্মারকলিপিটি রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়াও ৬টি মন্ত্রণালয়, মানবাধিকার সংস্থা, বিজিবি-পুলিশ প্রশাসন, উপজেলা চেয়ারম্যান, ওসিসহ বিভিন্ন বৌদ্ধ সমিতি এবং ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছে অনুলিপি পাঠানো হয়েছে। স্মারকলিপির সাথে নব্য খ্রিস্টান প্রচারক চাক ছেলে- মেয়েদের একটি নামের তালিকাও সংযুক্ত করা হয়।
এ ব্যাপারে চাক সম্প্রদায়ের নেতা ছানু অং চাক, বাচাচিং চাক, নাইন্দা অং চাক, ফোছা অং চাক, অংথোয়াইচিং চাক জানান, খ্রিশ্চিয়ান মিশন চাক ছেলে মেয়েদেরকে ধর্মান্তরিত করার কারণে ভবিষ্যতে বড় ধরনের ধর্মীয় দাঙ্গা হাঙ্গামার সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রশাসনিক সহায়তা পেতে সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি আহ্বান জানান।
সূত্র মতে, ধর্মান্তরিত করার এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার ব্যাপারে বেশ কয়েকটি এনজিওর নাম প্রায় সময় উঠে আসে। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি সংবাদে এসব এনজিওগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়।
এগুলো হচ্ছে- ক্রিশ্চিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট অব বাংলাদেশ (সিসিডিবি), অ্যাডভানটেজ ক্রুশ অব বাংলাদেশ, হিউম্যানেটারিয়ান বাংলাদেশ, গ্রিন হিল, গ্রামীণ উন্নয়ন সংস্থা (গ্রাউস), কারিতাস, ইভানজেলিক্যাল ক্রিশ্চিয়ান ক্রুশ, শান্তি রানী ক্যাথলিক চার্চ, জাইনপাড়া আশ্রম উদ্যান, আশার আলো, মহামনি শিশুসদন, বৈশানীয়, তৈমু প্রভৃতি। অভিযোগ উঠেছে, এসব সংগঠন মাসিক নগদ অর্থ সহায়তা ও প্রতি সপ্তাহে চাল, ডাল, তেল, কৃষি সামগ্রী সরবরাহের শর্তে এলাকার গরিব মানুষকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করছে। সম্পাদনা : রাশিদ রিয়াজ