মা-বাবার ভালবাসা নেই অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী
রিকু আমির : মা-বাবার ভালবাসার বদলে তীব্র অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী হয়েছে সাড়ে চার বছরের জোনায়েদ ও তিন মাসের জান্নাতুল ফেরদৌস অহমির ভাগ্যে। চা দোকানি বাবুল মাতবর ও লাকী বেগমের সন্তান তারা। মিরপুরের সেই আলোচিত চা দোকানি বাবুল মাতবর গত ৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও কথিত সোর্সের দেওয়া আগুনে নির্মমভাবে দগ্ধ হয়ে পরদিন মারা যান। আর তার স্ত্রী লাকী এক মাস আগে মারা যান জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে, বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে।
গতকাল রোববার দুপুরে কথা হয় বাবুলের সন্তানদের সঙ্গে। রাজধানীর মিরপুরে গুদারাঘাট এলাকার যে জীর্ণ একচালা ঘরে বাবুল সপরিবারে থাকতেন, সেই ঘরেই স্যাঁতস্যাঁতে ও পুঁতিগন্ধময় পরিবেশে বাবুলের বড় মেয়ে রোখসানার কাছে বড় হচ্ছে অবুঝ জোনায়েদ ও অহমি। মায়ের দুধের পরিবর্তে অহমির ভাগ্যে কোনোমতে জুটছে গুঁড়া দুধ। এর এক কৌটার দাম ৪০০ টাকা, তাতে চার দিনের বেশি যায় না। ছোট-খাটো অসুখ লেগেই থাকে প্রতি মাসে।
রোখসানার স্বামী রিকশা চালান। অহমির জন্য এসবের ব্যবস্থা করা তার পক্ষে বেশ কষ্টকর। প্রায়ই এর-তার কাছে হাত পাততে হয়। সারাদিন ছোটবোনকে আগলে রাখতে হয় বলে সময়মতো চুলায় রান্না চড়াতে পারেন না রোখসানা। প্রতিদিন বিকালে স্বামী ফিরলে তার কাছে অহমিকে দিয়ে রাতের রান্না সারেন।
জোনায়েদের আবদারের শেষ নেই। কিন্তু কে তা পূরণ করবে? সে জানে তার বাবা-মা জীবিত নেই। তবে তাদের অবর্তমানে এই শিশুমনের আবদার পূরণ করার যে আর কেউ নেইÑ এটা বোঝার বুদ্ধি জোনায়েদের এখনও হয়নি। এবারের রোজার ঈদে সে নতুন দুই সেট কাপড় পেয়েছে মেজো বোন মনি ও আরেক স্বজনের কাছ থেকে। কিন্তু শুধু এ দিয়েই কি জোনায়েদের দিন যায়?
ঘুমন্ত অহমিকে কোলে নিয়ে রোখসানা বলেন, ‘বাবা থাকলে এত চিন্তা ছিল না। বাবা-মায়ের জায়গা কি পূরণ করার ক্ষমতা আমার আছে? প্রতি সপ্তাহে এর খাওন-পিন্দনের পিছে অনেক খরচ হয়। জানেন, খুব কষ্ট হয়। কী করমু। বাবায় ওরে দিয়া গেছে মায়ের কাছে। মা দিয়া গেছে আমার কাছে। স্বামীর ইনকাম যদি ভালো থাকত, চিন্তা আছিল না। জোনায়েদকে তো সামলাতে ভীষণ কষ্ট হয়। এটা-সেটা চেয়ে বসে থাকে। কিন্তু কীভাবে দিব বলেন। আমারে না, আমার ভাই-বোনটার জন্য যদি কেউ কিছু কইরা দিত, তইলে শান্তি পাইতাম।’
ভেঙে যাওয়া রান্না ঘর দেখিয়ে রোখসানা বলেন, ‘মা মারা যাওয়ার পরে এই ঘরে আর রান্না করা হয় না।’
গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শাহ আলী থানা পুলিশ ও তাদের কথিত সোর্স বাবুল মাতবরের বাসার কাছেই ছোট্ট চায়ের দোকানে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তার মৃত্যু হয়। আজও পরিবারের অভিযোগÑ পুলিশ বাবুলকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। সরেজমিনে বাবুলের সেই দোকানে গিয়ে দেখা যায়Ñ ঘটনার পর থেকে দোকানের সরঞ্জাম সেখানেই পড়ে আছে।
বাবুলের ছয় সন্তান। তারা হচ্ছেনÑ বড় ছেলে রাজু পেশায় রিকশাচালক, তার এক কন্যা। এর পর রোখসানা, তার কাছে রয়েছে জোনায়েদ ও অহমি। মেজো মেয়ে মনির স্বামী সিএনজি অটোরিকশাচালক, থাকেন হাজারিবাগে।
বাবুলের চতুর্থ সন্তান লাবণী ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থেকে এবার এসএসসি পাস করেছেন। ঘটনার দিন তিনি বাংলা ২য় পত্র পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরেছিলেন। লাবণীরও সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে। তার স্বামী সুমন গার্মেন্টসকর্মী, থাকেন মিরপুর সেকশন ২-এর মসজিদ মার্কেটের কাছে, মা-বাবার সঙ্গে।
লাবণী বলেন, বাবার দোষ ছিলÑ ৭০ কেজি গাঁজাসহ মাদক ব্যবসায়ীদের ধরিয়ে দেওয়া। আমাদের মামলার ধরা পড়া আসামি পারুল জামিনে ছাড়া পেয়েছে। সে মামলার বাদী আমার বড় বোনকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিচ্ছে মামলা তুলে নিতে। মামলার অন্য আসামি রবিন দেলোয়ার, আইয়ূব আলীকে তো পুলিশ ধরতেই পারেনি। টাকার অভাবে আমরা উকিল দাঁড় করাতে পারিনি। তিনি বলেন, সে সময় জেলা প্রশাসক আমাদের এক বস্তা চাল, নগদ ৪০ হাজার টাকাসহ ঘর সংসারের বেশকিছু জিনিসপত্র দিয়েছিল। বলেছিল আমার বড় ভাই রাজুকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা দেবে। কিন্তু কোথায় অটোরিকশা… কেউ আমাদের খোঁজও নেয় না। আজকে আমার ছোট্ট ভাইবোন অসহায়। আমিও পড়ালেখা চালাতে পারলাম না। কিডনি রোগে আক্রান্ত মায়ের চিকিৎসাটা পর্যন্ত করতে পারলাম না…।
লাবণী বলেন, হাসপাতালে বাবার চিকিৎসা করাতেও টাকা পাইনি। অর্থ দিয়ে কিছু সাংবাদিক ভাই আমাদের সহযোগিতা করছিল। অ্যাম্বুলেন্সে করে বাবার লাশ এলাকায় আনার পর অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছিল মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলে।
রোখসানার মতো লাবণীও স্বপ্ন দেখেন, কেউ না কেউ তার এতিম, অবুঝ ভাইবোনদের পাশে দাঁড়াবে।
বি.দ্র: বাবুল মাতবরের সন্তানদের সঙ্গে ০১৬২৬-৫৩৩৩১৩, ০১৬৩১-০০৭৮৯৯ নম্বরে যে কেউ যোগাযোগ করতে পারেন। সম্পাদনা : হাসিবুল ফারুক চৌধুরী