মেয়েকে ডাক্তার বানাতে চান আবুল বাজনাদার
রিকু আমির : বৃক্ষমানব হিসেবে পরিচিতি পাওয়া খুলনার আবুল বাজনাদার তার একমাত্র সন্তান জান্নাতুল ফেরদৌস তাহিয়াকে (৩) ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। বর্তমানে তার দুই হাত শেকড় সদৃশ বস্তু থেকে মুক্ত, খুলে ফেলা হয়েছে ব্যান্ডেজও। গত ৩০ জানুয়ারি থেকে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন। বুধবার দুপুরে ওই ইউনিটের ৫১৫ নং কক্ষে তাকে বেশ হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় দেখা যায়। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী হালিমা খাতুন ও ছোট্ট মেয়ে তাহিয়া। মেয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ওরে ডাক্তার বানাইতে চাই। আমার মতো গরিবদের যাতে সে চিকিৎসা কইরা ভালা করতে পারে।’ আবুল বাজনাদারের দুই হাতে ক্ষত চিহ্ন এখনও দৃশ্যমান। আঙুল নাড়াতে পারলেও বাঁকাতে পারেন না। বেশি ওজনের কিছু তুলতেও পারেন না। আর দুই পা পুরু ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো। বাজনাদার বলেন, ‘হাতে ব্যথা নাই আগের মতন। ডাক্তাররা মলম লাগাতি দিসে। বইলসে, হাতের ব্যায়ামও করতি। খুব দ্রুতই নাকি আমি ভালা হমু।’
ন্যাশনাল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা সামন্ত লাল সেন এ প্রতিবেদককে বলেন, আবুল বাজনাদারের ডান হাত বেশ ভালো হয়েছে। বাম হাতে হয়তো আরও দুটি বা একটি অপারেশন লাগতে পারে। আর দুই পায়ে মাত্র একবার অপারেশন হয়েছে। এছাড়া ডান হাতে বাজনাদার কলম ধরতে পারছে। আমাদের বিশ্বাস, আর কিছুদিন পরই বাম হাতেও ডান হাতের মতো উন্নতি হবে।
আবুল বাজনাদারের দুই হাতে চারটি করে আটটি আর দুপায়ে একটি অপারেশন হয়েছে। ডাক্তারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সেন স্যার (ডা. সামন্ত লাল সেন), কালাম স্যার (বার্ন ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ), কবীর স্যার (দেশবরেণ্য চর্ম ডাক্তার অধ্যাপক ডা. কবীর চৌধুরী)- সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমার জন্য বহুত করছেন, তাদের জন্য আমার হাতের আজকে এই উন্নতি।’
ডা. সেন বলেন, বার্ন ইন্সটিটিউট প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলতে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখন হঠাৎই মনে হলো- বাজনাদারের হাতের একটি ছবি আছে। তখন প্রধানমন্ত্রীকে তা দেখালে উনি খুবই খুশি হন এবং বলেন, ‘ওকে সুস্থ করার জন্য যতটুকু করা দরকার, হাসপাতালে যতদিন থাকা দরকার রাখবা এবং ওকে সুস্থ করে তুলবা।’
এখন বাজনাদারের ফিজিওথেরাপি লাগবে। কারণ হাতের আঙ্গুলগুলো এতদিন স্টিভ হয়েছিল। এতবছর ধরে আঙ্গুলগুলো বন্ধ হয়েছিল, এখন ব্যায়াম করলেই সেগুলো সচল হয়ে যাবে। কয়েকটি ওষুধ দেওয়া হয়েছে, ডান হাতে সেগুলো লাগাতে হবে নিয়মিত, তাহলেই হাতের ওপরের অংশটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
হাতের শেকড়ের মতো অংশগুলো ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, এটাই এখন আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ- যেন তার হাতে এগুলো আর ফিরে না আসে। সার্জিক্যাল একটা অপারেশন করে একটা স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে, এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এগুলো যেন আর না হয়। সেজন্য আমেরিকাতে এ রোগের বিশেষজ্ঞ কাস্ট মার্টিনের কাছে বাজনাদারের টিস্যু, রক্ত, মূত্রসহ বেশকিছু জিনিস পাঠানো হয়েছে। সেগুলো নিয়ে আমেরিকা ও চীনেও কাজ হচ্ছে- এজন্য একটু সময় লাগছে। তারা গবেষণা করছে এ রোগটি নিয়ে। তারা আমাদের জানাবেন- এগুলো যেন আর ফেরত না আসে সেজন্য কী কী সতর্কতা নিতে হবে আমাদের।
ডা. সেন বলেন, বাজনাদারকে দিয়ে এটাই প্রমাণ হয় যে- বাংলাদেশেও ভালো চিকিৎসা হয়, বাংলাদেশের চিকিৎসা ইতিহাসে বাজনাদার একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, ‘ সততা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সবাই যদি নিবিষ্টভাবে কাজ করেন তাহলে বাংলাদেশেও উন্নত চিকিৎসা সম্ভব, সেটা বাজনাদারের অপারেশন দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে। যেকোনো চিকিৎসায় বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থায়, ডাক্তারদের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে এনেছে বাজনাদার। তার অপারেশন ছিল আমাদের জন্য আরেক চ্যালেঞ্জ। কারণ, আঙ্গুলগুলো তখন দেখা যেত না। অপারেশনের সময় আমাদের সতর্ক থাকতে হয়েছে যেন কোনো আঙ্গুলের ভেতরে থাকা শিরা কেটে না যায়, তাহলে আঙ্গুলই চলে যেত। বাজনাদারকে নিয়ে আমরা চেষ্টা করেছি- এখন পর্যন্ত আমরা সফল হয়েছি। সম্পাদনা : আ. হাকিম