অস্ত্রশস্ত্র শিয়রে নিয়েই রাত কাটাচ্ছে রায়পুরা উপজেলার চার গ্রামের বাসিন্দা
রিকু আমির, রায়পুরা (নরসিংদী) থেকে: হালকা থেকে ভারী পর্যন্ত দেশি অস্ত্রশস্ত্র শিয়রে নিয়েই তুমুল উত্তেজনাকর রাত কাটাচ্ছে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চার গ্রামের বাসিন্দারা। কেউ প্রতিপক্ষের উপর চরম প্রতিশোধের স্পৃহা থেকে, কেউ প্রতিপক্ষের হামলা ঠেকাতে এসব অস্ত্রকে রাতের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন। যেখানে গত ১৪ নভেম্বর রক্তক্ষয়ী টেঁটাযুদ্ধে নিহত হন চারজন। রায়পুরা থানার ওসি আজহারুল ইসলামসহ আহত হন শতাধিক গ্রামবাসী।
মঙ্গলবার রাতে রায়পুরা উপজেলার নিলক্ষা ইউনিয়নের আমিরাবাদ, সোনাকান্দি, বীরগাঁও, হরিপুর গ্রামে সরেজমিন দেখা যায়, হালকা থেকে ভারী দেশি অস্ত্রশস্ত্র শিয়রে নিয়ে ঘুমাচ্ছেন বা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন গ্রামবাসী। কারও ঘরে ফিসফিসিয়ে চলছিল এলাকার ঘটনা নিয়ে উত্তেজনাকর আলাপচারিতা।
এ প্রতিনিধি কিছু ঘরে প্রবেশের পর তোপের মুখে পড়তে হয়, এ সময় অস্ত্র উঁচিয়ে, চড়া কণ্ঠে পরিচয় এবং আসার উদ্দেশ্যও জানতে চান কেউ কেউ।
দেখা যায়, কমপক্ষে দুই থেকে তিন হাত লম্বা ছুরি, চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল, বল্লম, বর্শা, টেঁটা- এসব অস্ত্রের মধ্যে যেসবের আকৃতি কিছুটা ছোট সেসব বালিশের নিচে এবং সেখানে হাত রেখে শুয়ে আছেন কেউ কেউ। বড় অস্ত্রগুলো রাখা ছিল হাতের খুবই কাছে। এভাবে অস্ত্র নিয়ে শুয়ে আছেন কেন- জানতে চাইলে আমিরাবাদ গ্রামের তাজুল কিছুটা রাগান্বিত হয়ে, চোখ বড় বড় করে এ প্রতিনিধির দিকে তাকিয়ে বলেন, ওগরে (বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম সমর্থকরা) কাইট্টা লামু।
বলার সময়ই তিনি তার ডান হাতে থাকা চাইনিজ কুড়াল উঁচিয়ে ধরেন। কেন কাটবেন প্রশ্নে তিনি রাগত স্বরেই বলেন, আর কিছু জিগাইয়েন না। তার সঙ্গে কথা হয় মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে। রাত ৮টার দিকে বীরগাঁও আরশ আলী বাজার ঘেঁষা আনুমানিক ৬০ বছর বয়স্ক একজন ব্যক্তির বাড়িতে যায় এ প্রতিনিধি।
তিনি মূল ঘর সংলগ্ন একটি ছোট্ট ঘরে বসতে দেন প্রতিনিধিকে। যে চৌকিতে বসা হয়েছিল, সে চৌকিতে বিছানো তোশকের নিচে রাখা ছিল বেশকিছু বড় ছুরি। যার বসার পরই বোঝা গেছে। এছাড়া এ ঘরেরই দরজা সংলগ্ন একটি বড় ছুরি দেখা গেছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে ৬০ বছর বয়স্ক ব্যক্তিটি ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘কী করতাম, আমরা তো হেগোরে (গত ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যানে পদে হেরে যাওয়া আবদুল হক সমর্থক) কিছু কই না। হেরাই আমগো উপরে হামলা চালাইছে। এখনো যে এলাকায় এই অবস্থা, চাইট্টা (চারটা) মার্ডার হইছে, হেরফরেদাও (তারপরও) ডর করে, হের (আবদুল হক) পোলাপানরা যক্কন-তক্কন (যখন-তখন) মার্ডার কইরালায়।’
ঘরে এভাবে অস্ত্র রেখেছেন কেন- প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নিজেরে বাচানির লাইগ্গা রাখছি।’
একই গ্রামের আরেক ঘরের উঠানে যেতেই অস্ত্র শান দেওয়ার শব্দ পাওয়া যায়। দরজায় কড়া নেড়ে পরিচয় দেওয়ার পর ভেতরে নেওয়া হয় এ প্রতিনিধিকে। নাম না প্রকাশের শর্তে এ ঘরের ৩৫ বছর বয়স্ক একজন পুরুষ বলেন, ‘কখন কিতা অয়, কওন যায় না, রেডি থাকতে তো সমস্যা নাই।’ একটি বড় ছুরি ধার দিতে দিতে তিনি আরও বলেন, ‘পাইলেই হয়, একদম দম বাইর কইরা লামু।’
সোনাকান্দি গ্রামের রমজানের ঘরে প্রবেশের সময় বাধা না পেলেও প্রবেশের পরই আমার দিকে একটি বড় টেঁটা তাক করা হয়। এ সময় বলা হয়- ‘একটা গাই (জোরে গুঁতা) মারলেই শ্যাষ। এই পর্যন্ত দুইটা মার্ডার করছি এইটা দিয়া।’
নাম না প্রকাশ ও ছবি না তোলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি শর্তে তিনি আরও বলেন, ‘সব মাল (দেশি অস্ত্র) রেডি রাখছি। খালি লটকামু সবটিরে।’
এসব কথা বলতে বলতে তিনি আমাকে নিয়ে যান তার রান্না ঘরে। সেখানে দেখা যায়, কমপক্ষে ১০০ দেশি অস্ত্র।
পুলিশের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বেশ দম্ভোক্তি সুরেই বলেন, ‘ফুলিশ-ফালিশ কিতা? ফুলিশ এইহানো আইলে ফিরা যাইতারবোনি?’ এরপর তিনি এ গ্রামেরই আরও পাঁচটি ঘরে নিয়ে যান, যেখানে প্রত্যক্ষ করা গেছে, শুধু দেশি অস্ত্র আর অস্ত্র।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রায়পুরা থানার ওসি (তদন্ত) মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম মঙ্গলবার রাতে বলেন, পরিস্থিতি খুবই থমথমে। ঘরে ঘরে অস্ত্র নিয়ে যে যার মতন অবস্থান করছে, আমরা জানি। কিন্তু এই মূহুর্তে কোনো অভিযান করা যাচ্ছে না। হিতে বিপরীতের আশঙ্কা আছে। তবে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে গ্রামবাসীদের বোঝানো হচ্ছে, যাতে তারা বিবাদে না জড়ান। আর মামলা তো চলছেই। সম্পাদনা: আনোয়ার