সম্পত্তিতে নারীর অধিকার
ওয়ালি উল্লাহ সিরাজ
ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগে উত্তরাধিকারীদের জন্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পদে তাদের অধিকার সাব্যস্ত হতো না। বরং অনেক অস্থাবর সম্পদ যেমন-কাপড়, পাত্র, অলংকার, হাতিয়ার ইত্যাদি মৃতের অধিকার মনে করে তাদের লাশের সঙ্গে কবরস্থ করা হতো।
ইসলাম এসবের ওপর উত্তরাধিকারীদের অধিকার সাব্যস্ত করেছে। অন্যদিকে তারা প্রকৃত ওয়ারিশদের বঞ্চিত করে নিকটাত্মীয়দের সম্পদের অধিকারী সেজে পরস্পর বণ্টন করে নিত। কিন্তু ইসলাম একে সম্পূর্ণ অবৈধ ও অন্যায় হিসেবে ঘোষণা করেছে। সে যুগে নারী ও শিশুদের উত্তরাধিকারের উপযোগীই মনে করা হতো না। ইসলাম তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট অংশের ঘোষণা দিয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। ইসলাম ধর্ম মতে, মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তি যথানিয়মে বণ্টন করে দেওয়া ও প্রত্যেককে তাঁর প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়া অপরিহার্য। কুরআন ও হাদিসে উত্তরাধিকার সম্পত্তি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে।
ফিকাহবিদরা কুরআন ও হাদিস থেকে গবেষণা করে এ বিষয়ে ‘ফারায়েজ’ নাম দিয়ে স্বতন্ত্র শাস্ত্র রচনা করেছেন। শরিয়তের নীতি হলো, মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে প্রথমে তাঁর কাফন-দাফনের ব্যয় নির্বাহ করা হবে। এরপর তাঁর ঋণ পরিশোধ করা হবে। যদি ঋণ সম্পত্তির সমপরিমাণ কিংবা তারও বেশি হয়, তবে কেউ ওয়ারিশি স্বত্ব পাবে না এবং কোনো অসিয়ত কার্যকর হবে না। পক্ষান্তরে যদি ঋণ পরিশোধের পর সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকে কিংবা ঋণ একেবারেই না থাকে, তাহলে তাঁর কোনো শরিয়তসম্মত অসিয়ত থাকলে অবশিষ্ট সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ থেকে তা কার্যকর হবে। অসিয়ত কার্যকর করার পর অবশিষ্ট সম্পত্তি শরিয়তসম্মত ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে।
১৮৮২ সলের গধৎৎরবফ ডড়সবহং চৎড়ঢ়বৎঃু অপঃ.-এর আগে ব্রিটিশ আইনে নারীর সম্পত্তিতে কোনো অধিকার ছিল না। বিবাহের আগে নারীর উপার্জিত সম্পদের মালিকানা বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই চলে যেত তাঁর স্বামীর হাতে। অথচ সভ্যতার দাবিদার ব্রিটেনের ওই আইনের ১৩০০ বছর আগে মুহাম্মদ (সা.) সম্পত্তিতে নারীর অধিকারের কথা ঘোষণা করেছিলেন দীপ্ত কণ্ঠে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন : এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান। কিন্তু কেবল কন্যা যদি দুইয়ের অধিক থাকে, তাদের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ। আর মাত্র একজন কন্যা থাকলে তার জন্য (পুরো সম্পদের) অর্ধাংশ…। এটা আল্লাহর নির্ধারিত অংশ। ‘ [সুরা : নিসা, আয়াত : ১১]
পিতার সম্পত্তিতে নারীর এই নির্দিষ্ট অংশ পাওয়ার অধিকার ইসলাম ও আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনে স্বীকৃত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলেই নারীরা তাদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। আইন অনুসারে কন্যাসন্তানকে সম্পত্তির অংশ দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে তারা এর সুফল পাচ্ছেন না। দেশের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল ছাড়া প্রায় সবখানেই কন্যাসন্তানদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার একটি সামাজিক ট্র্যাডিশন তৈরি হয়ে গেছে। পৈতৃক সম্পত্তি থেকে নারীদের বঞ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে বিভিন্ন প্রথা গড়ে উঠেছে। কোনো কোনো সমাজের নিয়ম হলো, উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টনের সময় নারীকে তার অংশ দেওয়া হয়; কিন্তু নারী তার সম্পত্তি গ্রহণ না করে ভাইদের জন্য তার অংশটুকু ছেড়ে দেন। এটাই সামাজিকতা! এটাই সমাজের নিয়ম! এই প্রথার বাস্তবায়নে নারীদের মধ্যে স্বার্থবাদী সমাজ এক বিশেষ ধারণা তৈরি করেছে। তা হলো, পিতার সম্পত্তির অংশ গ্রহণ করলে ভাইদের কাছে ভবিষ্যতে বোনদের আর কোনো দাবি-দাওয়া থাকবে না। মামাবাড়িতে থাকবে না ভাগ্নে-ভাগ্নি কিংবা বোনজামাইয়ের কদর! সুতরাং জমির দাবি উত্থাপন করে ভাইদের সঙ্গে বাদানুবাদে না জড়ানোই শ্রেয় মনে করেন তাঁরা। কোনো কোনো অঞ্চলে আবার কন্যাসন্তানদের বঞ্চিত করা হয় ভিন্ন প্রতারণার মাধ্যমে। উত্তরাধিকার সম্পত্তি হস্তান্তর না করে নামেমাত্র মূল্য দিয়ে বিদায় করে দেওয়া হয় নারীদের।