বড়দিনের তাৎপর্য : প্রতিশ্রুত মুক্তিদাতা পরাক্রমশালী রাজা
পবিত্র বাইবেল অনুসারে মানব জাতির ইতিহাসে ইস্রায়েলীয়রা ছিল ঈশ্বরের মনোনীত জাতি। যুগে-যুগে ও কালে-কালে ঈশ্বর বিভিন্নভাবে তাদের লালন-পালন ও সেবা-যতœ করেছেন এবং শত্রুমুক্ত করে সর্বদা রক্ষা করেছেন (ইসাইয়া ১:২-৩)। তবে নিজেদের মধ্যকার নানান বিবাদে তারা ছিল যুদ্ধরত, বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন; এমন কি নিজ ভূমি হতে নির্বাসিত। তাদের প্রত্যাশা ও প্রার্থনা ছিল ঈশ্বর তাদের জন্য একজন রাজা পাঠাবেন। বিবাদমান ইস্রায়েল জাতির কাছে প্রবক্তা ইসাইয়া এই আশার বাণীই প্রচার করেছিলেন, ‘এক শিশু জন্ম নিয়েছেন আমাদের জন্য, তার নাম ‘আশ্চর্য মন্ত্রণাদাতা, শক্তিশালী ঈশ্বর, সনাতন পিতা, শান্তিরাজ’ (ইসাইয়া ৯:৫)। ‘তিনি দেশে দেশে বিচার সম্পাদন করবেন, বহু জাতির বিবাদ মিটিয়ে দেবেন। তারা নিজেদের তলোয়াড় পিটিয়ে করবে লাঙ্গলের ফলা, নিজেদের বর্শাকে করবে কাস্তে, এক দেশ অন্য দেশের বিরুদ্ধে তলোয়াড় উঁচু করবে না’ (ইসাইয়া ২:৩-৪)। তাঁর আগমনে প্রকৃতি ও সমাজের পরিবর্তন দেখা দেবে। মরুভূমি হবে উর্বরভূমি, বিচ্ছিন্ন-বিবাদে-বিভক্ত জাতি একত্রিত হবে, এমন কি ‘নেকড়েবাঘ মেষশাবকের সঙ্গে বাস করবে, চিতাবাঘ ছাগশিশুর পাশে শুয়ে থাকবে দুধের শিশু কেউটে সাপের গর্তের উপরে খেলা করবে’ (ইসাইয়া ১১:৬-৮)।
প্রবক্তা ইসাইয়া আরও বললেন, ‘তখন অন্ধের চোখ খুলে যাবে, বধিরের কান উন্মোচিত হবে। খোঁড়া মানুষ হরিণের মত লাফ দেবে, বোবার মুখ আনন্দচিৎকার করবে’ (ইসাইয়া ৩৫:৫-৬)। প্রবক্তার মুখে উচ্চারিত এই আশা ও শান্তির বাণী শুনে ইস্রায়েল জাতি অধীর আগ্রহ ও গভীর প্রত্যাশার পথ চেয়েছিলেন। দীক্ষাগুরু যোহন তাদের প্রস্তুতির আহ্বান জানান, ‘তোমরা প্রভুর আসার পথ প্রস্তুত করে রাখ, সোজা সরল করে তোল তাঁর আসার পথ’ (মথি ৩:৩)। সময়ের পূর্ণতায় ঈশ্বর তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। ‘আমি এক মহা আনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছি; আজ দাউদ-নগরীতে তোমাদের ত্রাণকর্তা জন্মেছেন তিনি সেই খ্রিস্ট, স্বয়ং প্রভু’ (লূক ২:১০-১১)।
আজ বড়দিন। আজ আনন্দের দিন, মিলনের দিন, একতার দিন ও উৎসবের দিন। আজ স্বর্গ রাজের তনয় আমাদের প্রেমের রাজা ও মুক্তিদাতা যীশু খ্রিস্ট জন্ম নিলেন। প্রবক্তা ইসাইয়ার ভবিষ্যদ্বাণী, দীক্ষাগুরু যোহনের সতর্কবাণী আর কুমারী মারীয়ার সম্মতির বাণীর ফলেই “বাণী একদিন হলেন রক্ত মাংসের মানুষ’ (যোহন ১:১৪)। বাণী দেহ ধারণ করলেন। ঈশ্বর মানুষ হয়ে জন্ম নিলেন। ‘বাস করতে লাগলেন আমাদেরই মাঝখানে’ (যোহন ১:১৪)।
ঈশ্বর পুত্রের জন্ম ইহুদীদের আশানুরূপ হলো না। কারণ, তাঁর জন্ম হলো গরীবের বেশে। তাঁর থাকবার ঘর বা জায়গা ছিল না। সাধারণ কাপড়ে জড়ানো তাঁর দেহ ছিল গোয়াল ঘরের যাবপাত্রে শোয়ানো (লূক ২:৭)। দীনবেশে জন্ম নিয়ে তিনি পৃথিবীর দীনতাকে বরণ করে নিলেন।
এই মহান রাজাধিরাজের জন্ম সংবাদ কোন রোমীয় শাসক বা সম্রাট, ইস্রায়েলের সামন্তরাজ বা রাজা কিংবা কোন রাষ্ট্রীয় ব্যক্তি বা মন্ত্রী পাননি। কোন ধনী মানুষ, প্রভাবশালী ব্যক্তি, ধর্মীয় গুরু বা রাজনৈতিক নেতা পাননি। রাজার জন্ম সংবাদ সর্বপ্রথমে রাখালেরা পেয়েছেন (লূক ২:১০)। দীনবেশে জন্ম নিয়ে তিনি সাধারণ, অসহায়, দূর্বল, ছোট ও গরীবের বন্ধু হয়েছেন। আমরা যারা দরিদ্র, অভাবী, অসহায়, অল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত, শ্রমিক বা রাখাল, আজ আমাদের জন্য বিশেষ আনন্দের সংবাদ। দীনবন্ধুর জন্ম আমাদের সাথে একাত্বতার প্রকাশ।
সাধারণ বেশে জন্ম হলেও তিনি সাধারণ নন। এই মহান রাজার জন্মের শুভ সংবাদ পেয়ে সুদূর পূর্ব দেশের পন্ডিত আকাশের তারা দেখে নব-রাজাকে খুঁজতে খুঁজতে বেথলেহেমে যান। শূন্য বা খালি হাতে নয়। তারা সাথে করে ‘স্বর্ণ পেটিকা, ধূপ-ধুনো ও গন্ধ নির্যাস’ (মথি ২:১১) উপহার হিসেবে নিয়ে যান। এই উপহার সাধারণ নয় এবং সাধারণ ব্যক্তিদের দেওয়া হয় না। এই উপহার একমাত্র সম্মানী ব্যক্তি, রাজা ও ঈশ্বরকেই দেওয়া হয়। তাই এ যার জন্ম হলো তিনি অসাধারণ, সম্মানীয়, পরাক্রমশালী রাজা এবং ঈশ্বর। তাই তো স্বর্গ-দূতেরাও আনন্দে গেয়ে উঠলেন, ‘জয় ঊর্ধ্বলোকে পরমেশ্বরের জয়। ইহলোকে নামুক শান্তি তাঁর অনুগৃহিত মানবের অন্তরে’ (লূক ২:১৪)। যীশু খ্রিস্টের আগমনে স্বর্গ-মর্ত্য আর পাতালে আজ আনন্দে মুখরিত।
প্রতিশ্রুত মুক্তিদাতার আগমন পৃথিবীতে শান্তি, একতা, মিলন ও ভালোবাসার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু তাঁর জন্মের দুই সহস্র বছর পরও আমাদের সমাজে শান্তি নেই, ক্ষমা নেই, মিলন ও ভালোবাসা নেই। পারস্পরিক হিংসা, অহঙ্কার, স্বার্থপরতা, ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়ীকতা, জঙ্গী হামলা ও যুদ্ধ সর্বদা বিরাজমান। জগতের এই অবস্থায় খ্রিস্টের আগমন ব্যর্থ বলে মনে হয়।
আজ তাঁর জন্মের শুভ বারতা এই ব্যর্থতার মাঝে সফলতার আভাস। ব্যর্থতা আসবেই তবে সফলতাই জীবনের পূর্ণতা। তিনি হতাশা-নিরাশা, অশান্তি আর ব্যর্থতার মাঝে আশা ও শান্তির বাণী শোনাতে এসেছেন। তাঁর আগমন আনন্দ ও পূর্ণতা দিতে। তাঁর জন্ম আজ আমাদের আহ্বান করছেন যেন হতাশা থেকে আশা, অসত্য থেকে সত্যে, অন্ধকার থেকে আলোতে আর পাপের জরা-জীর্ণতা থেকে ক্ষমা, মিলন ও ভালোবাসার রাজ্যে পদার্পণ করতে পারি। পরস্পরের নিকট ও ঈশ্বরের নিকট আমরা যেন উপহার হয়ে উঠতে পারি। তবেই খ্রিস্টের জন্মোৎসব বড়দিন হবে স্বার্থক, সুন্দর, পবিত্র এবং মিলন, সুখ ও আনন্দের।
লেখক: সহকারী ধর্ম যাজক, লক্ষ্মীবাজার ক্যাথলিক গীর্জা