নতুন বছরে পাপমুক্ত জীবন
ওমর শাহ
মানুষের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি কথা, উঠা-বসা, চলা-ফেরাÑ সবকিছুর ভালো-মন্দের হিসাব থাকা চাই। নতুন বছরে অতীতের ভালো মন্দের হিসাব থাকাটাও চাই। চাই পাপের জন্য অনুশোচনা আর নেকির জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। নববর্ষে আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করতে হবে অতীতের সকল গুনাহের জন্য। কারণ অতীত আমাদের জীবন থেকে মুছে গেলেও এগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখে সাক্ষীরা। আমরা যেখানেই থাকি; আলোতে বা আঁধারে, জনসমাবেশে বা লোকচক্ষুর অন্তরালে, দিনে কিবা রাতে, সকালে কি সন্ধ্যায়, সব সময়ই আমরা চারটি সাক্ষীর আওতাভুক্ত। কোনো কথা বা কোনো কাজ যত গোপনেই করি না কেন, চারটি সাক্ষী থেকে আমরা তা গোপন করতে পারি না। তারপরও কীভাবে আমরা নাফরমানীর পথে পা বাড়াই!
প্রথম সাক্ষী জমিন : আমাদের পায়ের নিচের মাটি, পায়ের নিচের আশ্রয়। প্রতিটি মুহূর্তে আমরা যার উপর অবস্থান করছি, চলা-ফেরা করছি, আহার গ্রহণ করছি, নিদ্রা যাচ্ছি। যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমাদের দান করছেন আমাদের রিজিক; হাজার রকমের ফল-ফসল, যা খেয়ে আমরা জীবন ধারণ করছি। প্রতিটি মুহূর্তে আমরা যার মুখাপেক্ষী। যার গর্ভ হবে আমাদের শেষ ঠিকানা। এই জমিন আল্লাহ তাআলার অনেক বড় একটি নিয়ামত। কিন্তু এই নিয়ামতের কথা আমরা ভুলে গিয়ে নাফরমানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ি। তারপরও জমিন তার রবের হুকুমে নীরবে বহন করে চলে আমার মতো পাপীকে। আমাকে সে গিলে ফেলে না। আল্লাহ নাফরমান বান্দাকে সতর্ক করে বলছেন, ‘তোমরা কি আসমানওয়ালার থেকে এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছ যে, তিনি তোমাদেরকে জমিনে ধ্বসিয়ে দেবেন না, যখন তা হঠাৎ থরথর কাঁপতে থাকবে? [সুরা মুলক : ৬৭-১৬]
হ্যাঁ, কোনো মানুষ জানে না আমার পাপের কথা। জমিন গিলে ফেলে না আমাকে। তবে…! তবে সে সাক্ষী হয়ে থাকে আমার নাফরমানির। তার সাক্ষী হওয়ার ব্যাপারে আমি উদাসীন, কিন্তু সে উদাসীন নয়। সে সব বলে দিবে, তার রব যেদিন তাকে বলার অনুমতি দিবেন। হে আমার রব, আমি সাক্ষী। তোমার এই বান্দা তোমার হাজারো নিয়ামত ভোগ করে, আমার পৃষ্ঠে অবস্থান করে, অমুক পাপ করেছিল, অমুক দিন করেছিল, অমুক সময় করেছিল। আমি তার সাক্ষী হে আল্লাহ!
জমিনের এই সাক্ষী হওয়ার বর্ণনা আল কুরআনুল কারীমে ও হাদিস শরিফে এভাবে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সেদিন জমিন তার যাবতীয় সংবাদ জানিয়ে দেবে। [সুরা যিলযাল ৯৯ : ৪]
দ্বিতীয় সাক্ষী ফেরেশতা : মানুষের অমলনামা লিপিবদ্ধের কাজে নিয়োজিত ফেরেশতা। আমরা যা ভাল কাজ করি তাঁরা তা লিপিবদ্ধ করেন। আমরা যা মন্দ কাজ করি তাঁরা তাও লিপিবদ্ধ করেন। তাঁরা তৈরি করেন এমন এক আমলনামা যা কোনো ছোট আমলও ছাড়ে না, কোনো বড় আমলও বাদ দেয় না। যে আমলনামা কিয়ামতের দিন আমাদের সামনে মেলে ধরা হবে। আমরা সেদিন স্বচক্ষে তা দেখতে পাব।
তাঁরা সম্মানিত ফেরেশতা, তাঁরা আমাদের অমলনামা লিপিবদ্ধ করছেন। সকালে সন্ধ্যায়, দিনে রাতে, সদা সর্বদা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য কিছু তত্বাবধায়ক (ফেরেশতা) নিযুক্ত আছে। সম্মানিত লিপিকরবৃন্দ। তোমরা যা কর তারা সব জানে। পূণ্যবানগণ তো থাকবে পরম স্বচ্ছনেদ্য; এবং পাপাচারীরা তো থাকবে জাহান্নামে। [সুরা ইনফিতার : ১০-১৪]
আমরা যা প্রকাশ্যে করি যা গোপনে করি, দিনের আলোয় করি বা রাতের অন্ধকারে করি, সব আল্লাহ জানেন। সাথে সাথে তাঁর ফিরিশতাগণও তা লিপিবদ্ধ করছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তারা কি মনে করে যে, আমি তাদের গোপন কথাবার্তা ও তাদের কানাকানি শুনতে পায় না? অবশ্যই শুনতে পাই। তাছাড়া আমার ফেরেশতাগণ তাদের কাছেই রয়েছে। তারা (সবকিছু) লিপিবদ্ধ করছে।’ [সুরা যুখরুফ : ৮০]
তৃতীয় সাক্ষী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ : আমার হাত, যা দ্বারা আমি ধরি। আমার এই পা, যা দ্বারা আমি চলি। আমার চোখ, যা দ্বারা আমি দেখি। কান, যা দ্বার আমি শুনি। এমনিভাবে আমার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যা আল্লাহ আমাকে দান করেছেন। যা আমার উপর আল্লাহ্ প্রদত্ত অসংখ্য নিআমতের অন্যতম। এসকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমার কাছে আল্লাহর আমানত। আমাকে এই আমানতের হেফাজত করতে হবে এবং এর খেয়ানতের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
আল্লাহ তো দুনিয়াতে বান্দাকে সুযোগ দিয়েছেন। দিয়েছেন নিজ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ইচ্ছামতো পরিচালনার স্বাধীনতা ও শক্তি। সাথে সাথে বান্দাকে সতর্কও করেছেন, (তরজমা) ‘আমি ইচ্ছা করলে অবশ্যই তাদের চক্ষুগুলো লোপ করে দিতাম, তখন তারা পথ চলতে চাইলে কীভাবে দেখতে পেত? এবং আমি ইচ্ছা করলে অবশ্যই স্ব স্ব স্থানে তাদের আকৃতি পরিবর্তন করে দিতাম, ফলে তারা (সামনেও) চলতে পারত না এবং (পিছেও) ফিরে আসতে পারত না।’ [সুরা ইয়াসিন : ৬৬-৬৭]
চতুর্থ সাক্ষী আল্লাহ তাআলা : আল্লাহ্ই হলেন সবচেয়ে বড় সাক্ষী, প্রথম ও শেষ সাক্ষী, যদিও এখানে চতুর্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি হলেন সর্বদ্রষ্টা, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী, যিনি অন্তরের কথাও জানেন। যাঁর থেকে গোপন থাকে না আসমান জমিনের কোনোকিছু। যিনি ‘আলিমুল গাইবি ওয়াশ শাহাদাহ্’; যাঁর কাছে দৃশ্য অদৃশ্য সবই সমান। ইরশাদ হচ্ছে, ‘এটা কি তোমার রবের সম্পর্কে যথেষ্ট নয় যে, তিনি সর্ববিষয়ে অবহিত?’ [সুরা হা-মীম : ৫৩]
তিনি আমাকে দেখছেন, আমি যে অবস্থায়ই থাকি, যেখানেই থাকি। তাঁর কাছে আসমান জমিনের কোনো কিছুই গোপন নয়। ‘নিশ্চিত জেনে রাখ, আল্লাহর কাছে আসমান জমিনের কোনো কিছুই গোপন থাকে না।’ [সুরা আলে ইমরান : ৫]
আল্লাহ বান্দাকে বিভিন্নভাবে সতর্ক করেছেন। আশা ও আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন। বান্দা গুনাহগার কিন্তু আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু। তাঁর দয়া অসীম, তাঁর ক্ষমা অতি ব্যাপক। সুতরাং হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আল্লাহ ক্ষমা করতে ভালবাসেন। তিনি ক্ষমাশীল সুতরাং আমরা তাঁর ক্ষমারই আশা রাখব এবং গুনাহ থেকে বাঁচতে চেষ্টা করব ও ক্ষমা চাইতে থাকব। নতুন বছরে অতীত জীবনের সকল গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজেকে গুনাহমুক্ত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করতে হবে।