স্বাধীনতার শেষ বিপ্লবী : জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
অজয় দাশগুপ্ত
বিস্মরণের এই কালে কে কাকে স্মরণ করে? কে মনে রাখে কাকে? এমন এক সময় এখন, মনে হয় সবকিছু নষ্টদের দখলে। আমাদের জীবনে এতদিন ধরে চলে আসা নিয়ম-নীতি-আদর্শ যেন হঠাৎ অচেনা হয়ে উঠতে চাইছে। আমরা সেই দেশের মানুষ যেখানে সততা আর বিদ্রোহ ছিল পরিপূরক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি হওয়ার এক নিরন্তর সাধনার ফল। সাম্প্রদায়িকতা আর শোষণের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল অনেককাল আগে। চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ে ব্রিটিশ শাসনের অবসান কামনায় প্রথম যে রক্তাক্ত সংগ্রাম তার নেতা ছিলেন মাস্টার দা সূর্য সেন। সে দ্রোহ ভারতবর্ষে প্রথম স্বাধীনতা ও মুক্তির পথ দেখিয়েছিল। আমরা সে লড়াই দেখিনি। আমাদের জন্ম হয়নি সে সময়ে। কিন্তু আমরা সে ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নায়ককে দেখেছি। যখন তিনি বয়োবৃদ্ধ অথচ নিয়ত লড়ছেন তখন তাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
জীবনে কে যে কি, আর কখন কেন আসে তার নির্বাচক সময়। যৌবনের শুরুতে আমি তাদের বাসায় যেতাম ইংরেজি শিখতে। তার ছোট ভাই ছিলেন আমার টিচার। সারা বাড়িময় কর্পূরের ঘ্রাণ আর তাম্বুলের মিষ্টি গন্ধ এখনো নাকে লেগে আছে। মিতভাষী আর অনুচ্চস্বরে কথা বলতেন তারা। আমরা এখন কথা বলতেই চেঁচাই। কেউ কারও কথা শুনি না। এরা ছিলেন তার বিপরীত। একসময় বিয়ে করার পর তার সঙ্গে নতুন সম্পর্কের সূচনা হয় আমার। তার বাড়ি আর আমার ছেলের মাতুলালয় পাশাপাশি। তারপরও মূল সম্পর্ক ছিল আদর্শ আর ইতিহাসের টানে বাঁধা।
আমাদের দেশে রাজনীতি এমন এক বিষয় যা কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। তাকেও ছাড় দেয়নি। প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক আওয়ামী লীগের প্রাক্তন মেয়র তাকে ডাকত বিনোদ ভিখারি। বিনোদ বিহারীকে ভিখারি নাম দেওয়ার কারণ তিনি কাউকে কারও জায়গা মেরে দেওয়ার সুযোগ দিতেন না। তার ইমেজ ও অতীতের সুনাম বা বিপ্লবী ভাবমূর্তির কারণে দেশজোড়া তার যে খ্যাতি সেটাকে জনকল্যাণের কাজে নিয়োজিত করে অপকর্ম ঠেকাতেন। সেটাই তাকে বিপদে ফেলত মাঝে মাঝে। কিন্তু তাতে কি? তিনি তো কৈশোরেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে গিয়েছিলেন। সূর্য সেনের বিপ্লবের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে ধরা পড়ে দ্বীপান্তরও হয়েছিল তার। বয়স কম বলে সে যাত্রায় বেঁচে যাওয়া তিনি পরে একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে বেঁচে ছিলেন এবং শেষদিন অবধি ছিলেন সক্রিয়। দীর্ঘসময় বাঁচার কারণে যা হয় তার সব ভুলে গিয়েছেন তিনি। স্ত্রী, পুত্র, আত্মীয় বিয়োগের পরও রবীন্দ্রনাথের ভাষায়Ñ আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু বিরহে দহন লাগে তুচ্ছ করে অমৃত আনন্দ অনন্তে জীবনযাপন করে গেছেন। তার চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে আমি গিয়েছিলাম দেখা করতে। আমার মা তখন শেষ শয্যায়। মার বয়স ছিল আশির উপরে আর তার একশোর অধিক। মার ছিল না স্মৃতিশক্তি আর তিনি অনায়াসে চিনতে পেরে বলছিলেন, অতীতের কথা। মা মারা যাওয়ার পর আমি যখন তাকে নিমন্ত্রণ করতে যাই তখনো তিনি স্মৃতিধর। সে সময় আমি অবাক হয়ে দেখেছি তার ধীশক্তি আর মানুষ চেনার আশ্চর্য গুণ। বারবার দেশের জন্য প্রার্থনা করতে গিয়ে বলতেন, অন্ধকার থেকে আলো তমস থেকে দীপ্তিতে আসার শ্লোক। অসৎকে সৎ হওয়ার সে আহ্বান জানানোর মানুষ আজ আর নেই বললেই চলে।
শতবর্ষের মহীরুহ বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী এদেশের শেষ ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী, যিনি ভারতেও সমান বন্দিত। হিন্দি ছায়াছবি যেটি এই সংগ্রাম ও চট্টগ্রাম বিদ্রোহ নিয়ে চিত্রায়িত সেটি তাকেই উৎসর্গ করেছে বলিউড। আমাদের দেশ, আমাদের সমাজও কম দেয়নি তাকে। ভালোবাসা ও সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক বিনোদ বিহারী চৌধুরী জন্মেছিলেন ১০ জানুয়ারি। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন আমারও জন্মদিন। আমার অন্তরমাখা প্রণতি আর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকে বলি, আপনার আরাধ্য বাংলাদেশ আপনাদের প্রিয় ও প্রার্থিত দেশ এখনো বুঝছে। নানা অপঘাত আর অপশক্তির বিরুদ্ধে এখনো নারী, শিশু, যুবক বা মানুষেরা অসহায়। আপনারাই তাদের শক্তি ও প্রেরণার উৎস। কোনোদিন যদি বাংলাদেশ আপনাদের পথ অনুসরণ করতে পারে তবেই তার পরিচয় ও ভবিষ্যৎ হবে নিষ্কন্টক। প্রয়াত বিনোদ বিহারী চৌধুরী আপনাকে আমরা জন্মদিনে ভুলিনি। আপনি ও বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম সমার্থক।
লেখক: সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান