বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : স্বাধীন বাংলাদেশের দৃঢ়ভিত্তি
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বঙ্গবন্ধু অভিবাদন মঞ্চে উঠলে গুর্খা বাদক দল বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা…’ বাজাতে শুরু করে। পালাম বিমানবন্দরের স্বাগত ভাষণে ভি.ভি গিরি বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘… আপনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এই অঞ্চলের স্থায়ী ও অটুট শান্তি প্রতিষ্ঠা, প্রত্যাশা ও সম্ভাবনা জোরদার ও সুনিশ্চিত করবে।’ প্রেসিডেন্ট গিরির স্বাগত ভাষণের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার জন্য এই ক্ষণ অত্যন্ত আনন্দের। বাংলাদেশে ফেরার পথে আমি আপনাদের মহান দেশের এই ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ, আপনাদের মহিমান্বিত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন এই সরকার ও ভারতের জনগণ যারা আমার জনগণের উত্তম বন্ধু তাদের প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এটি হলো আমার ন্যূনতম করণীয়। …নয় মাস পরে আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় আমি অবশেষে ফিরে যাচ্ছি। এই নয় মাসে আমার জনগণ বহু শতাব্দী অতিক্রম করেছে।’ নয়াদিল্লির জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান তার জনগণের নিকট স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং তিনি তা তাদের এনে দিয়েছেন। ভারত অঙ্গীকার করেছিল বাংলাদেশকে মুক্ত করবে, মুজিবকে মুক্ত করবে এবং সবশেষে শরণার্থীদের তাদের ভিটেমাটিতে পাঠিয়ে দেবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিশ্রুতি আমরা পালন করেছি।’ নয়াদিল্লির বিশাল জনসভায় জনতার উদ্দেশে আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ ও তার জনগণ আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, সরকার, সশস্ত্রবাহিনীর বীর সদস্যবৃন্দ এবং আপনাদের সাধারণ মানুষকে কোনোদিনই ভুলতে পারবে না, যারা তাদের দুঃখ-দুর্দশায় এবং সংগ্রামে সর্বাত্মক সহানুভূতি প্রদর্শন ও সমর্থন দান করেছেন। ২০টিরও অধিক দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধিবৃন্দ যাদের অধিকাংশই রাষ্ট্রদূত, বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধি ছিলেন সোভিয়েত ব্লকের। ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালি, পশ্চিম জার্মানি, নরওয়ে এবং ডেনমার্কের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। বিমানবন্দরের অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও আরবদের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। নয়াদিল্লির জনসভায় বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ ইংরেজিতে শুরু করেছিলেন। শুরুতে জনতার মধ্য থেকে চিৎকার ভেসে আসে বাংলায় বলার জন্য। হাসি দিয়ে সম্মতি প্রকাশ করে তিনি তার মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিতে শুরু করেন। আর জনতা মহোৎসাহে তাদের সমর্থন জানায়। আনুষ্ঠানিকতার পর ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে যান বঙ্গবন্ধু। দিল্লি অবতরণের পূর্বেই বিমানে থাকা অবস্থায় তার সফরসঙ্গী ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা শশাঙ্ক এস. ব্যানার্জির মাধ্যমে ভারতকে জানিয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা বঙ্গবন্ধুর কাছে সবচেয়ে জরুরি। পরামর্শকদের সঙ্গে আলোচনার শুরুতেই ইন্দিরা গান্ধী জানালেন, মুজিবের প্রস্তাবে তিনি রাজি। যথাসময়ে ইন্দিরা-মুজিব বৈঠক শুরু হলো। ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি ইন্দিরা-মুজিব যৌথ ইশতেহারে স্থান পেল। প্রথমে কথা ছিল ভারতের সৈন্য প্রত্যাহারের তারিখ হবে জুন, ১৯৭২। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় তা হলো মার্চ, ১৯৭২। আজকাল কোনো দেশে শত্রু অথবা মিত্র হিসেবে অন্যদেশের সৈন্য ঢুকতে দেরি না হলেও বেরোতে অনেক দেরি হয়। আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র বাংলাদেশ থেকেই তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য অপসারিত হয়। এই অসম্ভবই সম্ভব হয় একমাত্র বঙ্গবন্ধুর জন্য।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বিকালে বঙ্গবন্ধু লন্ডন দিল্লি হয়ে প্রাণের শহর ঢাকা ফিরে আসেন বেলা ১টা ৪১ মিনিটে। ঢাকায় অবতরণের পূর্বে কমেট বিমানটি বঙ্গবন্ধুর অভিলাষের প্রতি শ্রদ্ধাবশত প্রায় ৪৫ মিনিট বিমানবন্দরের উপর চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। উপর থেকে তার ‘সোনার বাংলা’কে অবলোকন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। অভ্যর্থনায় অনেক কূটনীতিক আসলেও চীন ও ইরানের কনসাল জেনারেলদ্বয় অনুপস্থিত ছিলেন, তবে যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বার্ট ডি. স্পিভাক এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে করমর্দন করার সময় সৌজন্য প্রকাশের জন্য সামান্য অবনত হন এবং বলেন ‘ঢাকায় স্বাগতম’। বঙ্গবন্ধু হেসে উত্তর দেন, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ’। বিমানবন্দর থেকে লাখো জনতার ভিড় ঠেলে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে। সেদিন রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন, তার দুই চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়ছিল বারবার। তিনি কান্নারত কণ্ঠে বলেন, ‘বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি, বিশ্বকবি তোমার সেই আক্ষেপ মিথ্যা প্রমাণিত করে সাত কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে।’ আওয়ামী লীগের নির্বাচনি প্রতীক নৌকার মতো করে নির্মিত ১০০ ফুট দীর্ঘ মঞ্চ থেকে ৩৫ মিনিটের ভাষণে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম, তোমরা আমাকে মারতে চাও মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালিদের কাছে ফিরিয়ে দিও…। আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, মানুষ একবারই মরে… মরার আগে বলে যাব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, জয় বাংলা…।’ বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, গত ৭ মার্চ আমি এই রেসকোর্সে বলেছিলাম ‘দুর্গ গড়ে তোলো’। আজ আবার বলছি, আপনারা একতা বজায় রাখুন। আমি বলেছিলাম, ‘বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ‘ইনশা-আল্লাহ’। বাংলাদেশ আজ মুক্ত স্বাধীন। …আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, নেতা হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি …যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায় তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবেÑ পূর্ণ হবে না। …বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তি হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। (শেষ)
সম্পাদনা: আশিক রহমান