ভুলে ভরা পাঠ্যবই এবং ‘জিপিএ ফাইভ’!
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে
কথায় বলে, পাঠ্যপুস্তকে সরল, সুসামঞ্জস্য ও সংযত সম্পাদন ছাড়া শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির গুণসম্পন্ন ঐতিহ্য লালন সুদূরপরাহত। এবার তারই স্বীকৃতির বহির্প্রকাশ ঘটেছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দেশব্যাপি বিতরণকৃত পাঠ্যপুস্তকে, যা প্রকারান্তরে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে আক্রান্ত করেছে। কেননা তারা উভয়ে তা সগৌরবে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মাঝে বিতরণ করেছেন। ওই বইগুলো ইংরেজি বছরের শুরুর দিন থেকেই প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। তারা অবিলম্বে শিশু-কিশোরদের হাতে পৌঁছানো বইগুলো বাতিলের ঘোষণা চান এবং বাজার থেকে ওইসব বই দ্রুত তুলে নেওয়ার কথা বলেন (দ্রষ্টব্য: দৈনিক আমাদের অর্থনীতি, জানুয়ারি ৭, ২০১৭)।
এই যখন অবস্থা, তখন টরন্টো প্রবাসী কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদও তার ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল চৌধুরীসহ ৮১ জনকে সংযুক্ত করে নিজের প্রতিক্রিয়াটি ব্যক্ত করেছেন। তিনি কুসুমকুমারী দাশ রচিত ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতার দুটি তুলনামূলক মুদ্রিত পাতা তুলে ধরে শুধু শব্দের হেরফের নয়, বরং সেখানে ছত্র লোপাটের প্রমাণ দিয়েছেন। আর মন্তব্যে লিখেছেন, ‘কোন শু—-র বাচ্চা এই কবিতা এডিট করে পাঠ্য পুস্তকে ঢুকিয়েছে? একের পর এক কি হচ্ছে এই সব’?
এতে এই লেখাকালীন তাতে ১৪০টি লাইকের পাশাপাশি ৩২ জনের মতামত প্রতিভাত। সেই মতামতের কয়েকটি, যেমন- ‘ভাই, সুকৌশলে নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত একটা নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি করাই এই শু—-র বাচ্চাদের মিশন’; ‘প্রফেসর সাব তো কইয়া দিছে এডিট করা যায়েজ’; ‘সবাই বাতাসে লাথি মারছেন কেন? কারা সম্পাদনা করেছে তাদের নাম তো সব পাঠ্য বইয়ের প্রিন্টার্স লাইনেই আছে। তাদের ডাইরেক্ট ধরুন। জবাব দিক’; ‘ধিক্কারের ভাষা নাই’; ‘ইস্! শিক্ষায় একেবারে ধস নামানোর ব্যবস্থা’; ‘আমাদের জনাব নাহিদ সাহেব ছাড়া আর কে? মিনিস্টার অব জিপিএ ৫’; ‘আওয়ামী আমলে এসব হচ্ছে। আর কাকে আঁকড়ে ধরি, কোন ভরসায়’; ‘হেফাজতের ১২ দফা পূরণ করা হয়েছে। মন্ত্রীদের কেউ কেউ আল্লামা সুফির মুরিদ’; ‘চেতনার নামে চেতনাবিনাশী তিমিরে ধাবমান আমরা’; ‘ভোটের সাথে বেহেস্ত চাই যে’ এবং ‘ধোলাই দেওয়া দরকার। এসব দেখে গা জ্বলে যায়’। এরই একপর্যায়ে জনৈক মাঈন চৌধুরীর মন্তব্য ‘কু—-র বাচ্চারা যা পারেনি শু—-র বাচ্চারা তা করে দেখাচ্ছে’র জবাবে কবি দুলাল পেছনের দুই পায়ে বসা ‘সারমেয়’ সদৃশ্য পাকিস্তানের ম্যাপ সংবলিত ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘১০০% হাচা কথা’। আর হার্ভার্ড শিক্ষিত সেজান মাহমুদ স্বরচিত ‘পায়ের নিচে এভারেষ্ট’ তদবিরবিহীন ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ শ্রেণির চারুপাঠে অন্তর্ভুক্তি প্রসঙ্গে ক্ষেদোক্তিতে লিখেছেন, ‘এবারে [কবি] জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশের কবিতা আদর্শ ছেলেকে সম্পাদনা করে উল্টেপাল্টে দেওয়া হয়েছে’।
বাস্তবে ওই ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি উল্টেপাল্টে ফেলার পাশাপাশি দেশের প্রাজ্ঞ ও বিদগ্ধ অভিভাবকেরা কখনো কী ভেবেছেন আঘাতের সমার্থক শব্দ হচ্ছে ‘হৃদয়’, ছেলেশিশু-মেয়েশিশু নির্বিশেষে জানতে হবে ওড়নার ব্যবহার, ‘ছাগলে কিনা খায়’ ওই সূত্রে আম খাওয়াটা বাধ্যতামূলক এবং মননশীলতার জন্য নিজেদের হাজার বছরের রূপকথা ও গল্পের পরিবর্তে পড়া চাই বিদেশি গল্পের অনুবাদ! এমনকী মহানবী (সা.) ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিবর্জন জরুরি! এসবের দায়িত্ব নিয়েছে বাংলা একাডেমি ও এনসিটিবি (ন্যাশনাল কারিকুলাম অ্যান্ড টেক্সটবুক বোর্ড)।
এদিকে দেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে ‘জিপিএ ফাইভ’ প্রাপ্তিÍ বিষয়ে গত ৭ জানুয়ারি স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ২২ মিনিটে টরন্টো প্রবাসী বিশিষ্ট সমাজসেবী মাহবুব রব চৌধুরী তার ফেসবুকে জনৈক আবদুল হক সরকারের একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে তাতে পরীক্ষার উত্তরপত্রে ইংরেজিতে গরু রচনা ও বাংলা বাক্যের ইংরেজিকরণ তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে ভুল ব্যাকরণ ও হুবহু বাংলা শব্দ ব্যবহারে মোট ছয়টি ইংরেজি বাক্য গঠন করে রচনাটি লেখা হলেও ১৫-তে ১৪ নম্বর এবং একই ধরনের ভুল শব্দ ও ব্যাকরণে চারটি বাংলা বাক্য ইংরেজিকরণের ক্ষেত্রে ১০-এ ১০ নম্বর দেওয়া হয়েছে। সে জন্য মন্তব্যে বলা হয়েছে- ‘এই জন্যই দেশে জিপিএ-৫ এর এত ছড়াছড়ি। শেয়ার করে সবাইকে দারুণ এই ব্যাপারটা দেখার সুযোগ করে দিন’।
সম্ভবতঃ দেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির বিষয়টা এতটা নম্বর সর্বস্ব নয়। তবুও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দেশব্যাপি বিতরণকৃত পাঠ্যপুস্তকে যে ভুলের ফিরিস্তি দেখছি, তাতে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির বিষয়টা অবজ্ঞা করি কী করে যেখানে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা! বরং শিক্ষার্থীদের মাঝে এই ভুল সংশোধনের পাশাপাশি সামগ্রিক শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘জিপিএ-৫’ প্রাপ্তি উৎসাহিতকরণে যা প্রয়োজন, তা হলো কানাডার টরন্টো ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ড অনুসৃত ‘এক্সপেকটেশন ফ্রম টিচার’ বা শিক্ষক থেকে প্রত্যাশা ও ‘এক্সপেকটেশন ফ্রম স্টুডেন্ট’ বা শিক্ষার্থী থেকে প্রত্যাশা, অর্থাৎ ‘কী শেখাবেন ও কী শিখেছে’ বিষয়ক জ্ঞান আদান-প্রদান নির্ভর পারস্পরিক পরিম-লকে সবিশেষ জাগ্রত করা। নতুবা এবার দেশের যে ৪ কোটি ৩৩ লাখ ৫৩ হাজার ২০১ জন কোমলমতি শিক্ষার্থী পাঠ্যবই বিতরণের দিনে ‘শিক্ষা নিয়ে গড়ব দেশ, আমাদের এই বাংলাদেশ’ সেøাগানের পরিবর্তে ‘শিক্ষা নিয়ে গড়ব দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ শিখেছে, তাতে দেশপ্রেম, মানবিকতা ও সহনশীল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবর্তে এক কূপম-ুক সংকীর্ণ মানসিকতাতেই গড়ে উঠবে। কেননা বিতরণকৃত ওই বইগুলোর পেছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবির নিচেই ইংরেজিতে ছাপা হয়েছে আঘাতের সমার্থক ‘হৃদয়’ হিসেবে ‘ডু নট হার্ট অ্যানিবডি’!
ইমেইল: নঁশযধৎর.ঃড়ৎড়হঃড়@মসধরষ.পড়স