জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে সরকারের সাফল্য
মিল্টন বিশ্বাস
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
১২ জানুয়ারি (২০১৭) বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের তিন বছর পূর্ণ হলো। সাফল্যের অনেক সূচকের মধ্যে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসদমনে তাদের অনুসৃত পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে-পরে জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসদমন করে আওয়ামী লীগ সরকার দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এনেছে। তারপর ২০১৬ সালের ১ জুলাই জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যদের দ্বারা হলি আর্টিজানের নির্মম হত্যাকা- সারা বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিলেও সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশের মধ্য থেকে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের শেকড় উৎপাটন করা সম্ভব হয়েছে। একই বছর দেশের কয়েকটি স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার অবসান কল্পে দোষী ব্যক্তিদের বিচার সম্মুখীন করা হয়। সরকারের সদিচ্ছা দেশের মানুষকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের উপর আস্থাশীল করে তুলেছে। তৈরি হয়েছে মধ্যম আয়ের দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি।
২.
গত মহাজোট সরকারের আমলে ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ ধর্মীয় পুরোহিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী, ভিন্নমতের ইসলামি ভাবধারার অনুসারী, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কর্মকর্তা ও বিদেশিদের উপর একের পর এক চাপাতি, গুলি ও ধারাল অস্ত্রের হামলা বর্তমান সরকার তথা শেখ হাসিনার জঙ্গিবাদ দমনের অবদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছিল। গত বছর ২০ মে পুনরায় চাপাতির আঘাতে খুন হন কুষ্টিয়ার হোমিও চিকিৎসক মীর সানাউর রহমান। আহত হন তার বন্ধু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইফুজ্জামান। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক হত্যার এই ‘চক্র’ ভাঙার আহ্বান জানিয়ে সরকারের উদ্দেশে ইউরোপিয় মিশনগুলোর প্রধানরা ওই বছর ২২ মে বলেন, এই ধরনের হামলা চলতে থাকলে তা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে পারে। এসব হামলা মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসের প্রতি ‘নজিরবিহীন হুমকি’ তৈরি করেছে বলে মন্তব্য করেন তারা। আর এ ধরনের ঘটনা মুক্ত, সহনশীল এবং স্থিতিশীল ও সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের পরিচয় মুছে দিতে পারে।
এসব হামলার অনেকগুলোতে দায় স্বীকার করে আইএস ও আল-কায়েদার নামে বার্তা এলেও সরকার বলছে, অভ্যন্তরীণ জঙ্গিরাই এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের মতে, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ‘ক্ষুণœ’ এবং সরকারকে সমস্যায় ফেলতে জামায়াতে ইসলামী ও এর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এসব হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার খুনের পর থেকে টাঙ্গাইলে হিন্দু দর্জি নিখিল জোয়ারদার হত্যাকা- পর্যন্ত ৩৭টি হামলার মধ্যে ২৫টি জেএমবি, আটটি আনসারউল্লাহ বাংলা টিম ও চারটি ঘটনা অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠী ঘটিয়েছে। অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোষ্ঠী যেমন জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি), আনসার আল-ইসলাম, আনসারল্লাহ বাংলা টিম, হরকাতুল-জিহাদ-আল-ইসলাম (হুজি-বি), হিজবুত তাহরির বাংলাদেশ এবং নতুন আবির্ভূত আল মুজাহিদ প্রভৃতি এসব হত্যাকা-ে জড়িত। হামলা ও হত্যাকা-ের মধ্যে ৩৪টিরই মূল রহস্য উদঘাটিত হয়েছে বলে দাবি করেন পুলিশপ্রধান। এর মধ্যে মাত্র ছয়টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
১ জুলাই(২০১৬) হলি আর্টিজানের হত্যাকা-ের আগে সংঘটিত কুষ্টিয়ার হত্যাকা-ের ধরনের সঙ্গে ২০১৩ সাল থেকে ঘটে যাওয়া হত্যাকা-গুলোর মিল রয়েছে। যারা এসবের শিকারে পরিণত হচ্ছেন, তাদের মধ্যেও বৃহত্তর পরিসরে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। তারা হয় ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন মতাদর্শের বা ভাবধারার অথবা জীবনযাপনের ক্ষেত্রে রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অথবা সাংস্কৃতিকভাবে সক্রিয়। ফলে এটা ধরে নেওয়া খুবই সংগত যে পরিকল্পিতভাবেই এসব ঘটনাগুলো ঘটছে এবং এসবের পেছনে সংগঠিত শক্তি রয়েছে। আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত তরুণ প্রজন্মের অনেকেই আজ জঙ্গিবাদী নাগিনীর দংশনে ক্ষতবিক্ষত। খুন করা হয়েছে ৩৭ জনকে, খুনের হুমকি রয়েছে শতাধিক মানুষের মাথার উপর। ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৫ জন ব্লগারকে তাদের লেখালেখির কারণে হত্যা করা হলেও ওই মামলাগুলোর খুব বেশি অগ্রগতি নেই। আহমেদ রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায় ও ওয়াশিকুর রহমান এবং অনন্ত বিজয় দাশ ও নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় এবং জুলহাস, তনয় অথবা নাজিমের জন্য আমরা এ পর্যন্ত কিছুই করতে পারিনি। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। খুন করেছে আজিজ সুপারের জাগৃতি প্রকাশনীর তরুণ প্রকাশক দীপনকে। অন্যদিকে ব্লগারদের মতো একই কায়দায় একইদিন হামলার শিকার হয়েছেন অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল। টুটুলের সঙ্গে আহত হয়েছেন ব্লগার তারেক রহিম ও রণদীপম বসু। ফেব্রুয়ারিতে(২০১৫) অভিজিৎ নিহত হওয়ার পর ফেসবুকে হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়ে টুটুল মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। উল্লেখ্য, বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের ‘অবিশ্বাসের দর্শন’সহ কয়েকটি বই বের করেছে শুদ্ধস্বর। অভিজিৎ খুনে যেমন ৪/৫ জনের দল পরিকল্পিতভাবে কাজ করেছিল ঠিক একইভাবে এই হামলাকারীরা ছিল পাঁচজন। তারা ঢুকেই বলেছিল, ‘আমরা টুটুলকে মারতে এসেছি।’ অফিসে ঢুকে কুপিয়ে তালা মেরে চলে গেছে তারা। এসব ক্ষেত্রে নিহতদের দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করা হয়েছে। প্রত্যেককেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। প্রত্যেকটি ঘটনার পরই ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠনের নামে দায় স্বীকার করা হয়েছে।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের উপর জঙ্গিদের চাপাতি হামলার পর রাজিব হায়দারকে চাপাতির আঘাতে খুন করা হয় ২০১৩ সালে। ব্লগে লেখালেখির কারণে বাংলাদেশে প্রথম কোনো হত্যাকা- এটি। মুক্তমনা নামে ব্লগ সাইটের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কেও গতবছর ২৬ ফেব্রুয়ারিতে সস্ত্রীক বাংলা একাডেমির বইমেলা দেখে ফেরার পথে চাপাতির আঘাতে প্রাণ হারান। তার স্ত্রী রাফিদা বন্যা আহমেদও মারাত্মক আহত হন। অভিজিৎ রায়কে হত্যার এক মাসেরও কম সময়ের মাথায় ৩০ মার্চ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে ঢাকার তেজগাঁও এলাকার একটি সড়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যা করা হয় গত ১২ মে, সিলেটে। ঢাকার বাইরে এটাই একমাত্র ব্লগার হত্যাকা-ের ঘটনা। অনন্ত বাসা থেকে বের হয়ে একটি ব্যাংকে যাবার পথে হামলার শিকার হন। তিনি মুক্তমনা ব্লগে লিখতেন এবং সিলেট থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞানবিষয়ক একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। গত ৭ অগাস্ট দুপুরে রাজধানীতে বাড়িতে ঢুকে হত্যা করা হয় ব্লগার নীলকে। ২৫ এপ্রিল(২০১৬) সমকামী মানবাধিকার কর্মী জুলহাজ মান্নান এবং তার বন্ধু মাহবুব রাব্বি তনয়কে ঢাকার কলাবাগানের এক বাসায় কুপিয়ে হত্যা করে অজ্ঞাতনামা একদল লোক। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সিলেটের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। অন্যদিকে ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। (চলবে-১)
সম্পাদনা: আশিক রহমান