তাবলিগের স্বপ্নদ্রষ্টা হজরত ইলিয়াস (রহ.)
মুফতি আরাফাত হুসাইন
হজরত ইলিয়াস (রহ.)। ভারতবর্ষের উত্তরপ্রদেশের মুযাফ্ফর নগর জেলার অন্তর্গত কান্ধালা নামক শহরে ১৩০৩ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল নানার বাড়ি কান্ধালায় এবং নিজ পিতা হজরত মাওলানা ইসমাইল (রহ.) এর সান্নিধ্যে দিল্লীর নিযামুদ্দীনে অতিবাহিত করেন। তখন তার পুরো পরিবার কান্ধালায় অবস্থান করছিলো। পরিবারের নারী-পুরুষ সকল সদস্যবৃন্দের মধ্যে ঈর্ষণীয় ধর্মপরায়ণতা ছিল। সদাসর্বদাই তারা অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত ও জিকিরে মশগুল থাকতেন।
পরিবারের অন্য শিশুদের মতো তারও মকতব থেকে শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী শৈশবেই কুরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। এই পরিবারের হিফজুল কুরআন এর প্রচলন এতো ব্যাপক ছিল যে মসজিদের দুই কাতার পর্যন্ত মুয়াজ্জিন ছাড়া কোনো গাইরে হাফেজ (যে কোরআন মুখস্ত করেনি) দাঁড়াতো না। হজরত ইলিয়াস রহ. ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় গভীর মনযোগী ছিলেন। প্রতিদিনের পড়া শেষ করে বাকি সময় জিকির ও অন্যান্য অযিফায় কাটিয়ে দিতেন। শেষ রাত্রে নিয়মিত তাহাজ্জুদ, নামাজ, জিকির, দোয়া ও কান্নাকাটি-আহাজারিতে নিমগ্ন থাকতেন। শাইখুল হাদিস হজরত মাওলানা শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী (রহ.) এর কাছে হাদিস পড়ার জন্য ১৩২৬ হিজরিতে দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন এবং শাইখুল হিন্দ রহ. এর কাছে বুখারি শরিফ ও তিরমিজি শরিফ পড়েন।
শিক্ষাজীবন সমাপ্তের পর ১৩২৮ হিজরিতে মাওলানা ইলিয়াস রহ. সাহারানপুর মাযাহিরুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৩৩০ হিজরি মোতাবেক ১৭ এপ্রিল ১৯১২ সালে তিনি মামা মৌলভী রওফুল হাসান সাহেবের কন্যাকে বিয়ে করেন। ১৩৩৩ হিজরিতে হজ পালনের জন্য মক্কা শরিফে গমন করেন। মেঝ ভাই ও বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি ভক্ত ও অনুরক্তদের অনুরোধে বস্তি নিযামুদ্দীনে অবস্থিত মসজিদ ও মাদরাসার সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর ১৯২০ সালে তিনি ভারতের মেওয়াত অঞ্চল থেকে তাবলিগি দাওয়াতের সূচনা করেন।
এটি দিল্লীর দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলটি ছিল ‘মেও’ জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি। বর্তমানে গোরগাঁও, আলাওয়ার, ভরতপুর ও মথুরার কিছু অংশ নিয়ে মেওয়াত এলাকা বিস্তৃত। এই অঞ্চলের জনগণ ছিল নামে মাত্র মুসলমান। তাদের আচার-আচরণ ছিল বহুক্ষেত্রে আরব জাহেলিয়াতের কাছাকাছি। আর্যদের এ দেশে আগমনের বহু পূর্ব থেকে মেও গোষ্ঠীরা এই এলাকায় বসবাস করতো। দিল্লীর মুসলিম সালতানাতের যুগে মেওয়াতীরা বনজঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে লুটপাট করতো। ১২৬০ সালে গিয়াসুদ্দীন বলবান মেওয়াতী দস্যুদের শায়েস্তা করার জন্য এক বড় অভিযান পরিচালনা করেন। এমন একটি এলাকা থেকেই তাবলিগ জামাতের সূচনা বিস্ময়কর।
জীবনের শেষ দিকে মাওলানা ইলিয়াস রহ. ইলম ও ফিকিরের প্রতি তাকিদ ও তারগিব দিতে লাগলেন। যারা অশিক্ষিত, তাদের প্রতি বেশি দরদ দেখালেন। জাকাত আদায় করা ও তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার ওপর জোর দিলেন।
১৯৪৪ সালের ১২ জুলাই মৃত্যুর একদিন আগে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কাল কি বৃহস্পতিবার? বলা হলো ‘জ্বি হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, আমার কাপড়-চোপড় দেখে নাও কোনো নাপাকি আছে কিনা। নেই শুনে খুশি হলেন। ভোররাতে ফজরের আজানের কিছুক্ষণ আগে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।