উপমহাদেশের প্রাচীনতম অক্ষত হলি রোজারি চার্চ
খ্রিস্টীয় দর্পণ ডেস্ক
ফার্মগেট থেকে তেজগাঁওমুখী রাস্তা ধরে সামান্য এগোলেই হলি রোজারি চার্চ। প্রবেশ তোরণ পেরিয়েই চোখে পরে বেশ কিছু খোলা জায়গা। অত্যন্ত নিরিবিলি পরিবেশ। শুরুতেই কবরস্থান, তারপর পুরনো গির্জা, এরপর নতুন গির্জা। পুরনো গির্জাটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে আরাধনালয় হিসেবে। স্থানীয়ভাবে চার্চটি ‘জপমালা রাণীর গির্জা’ নামে সমধিক পরিচিত। ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এ গির্জাটি রোমান ও পর্তুগিজ স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণে গড়া। মুগল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) এর নিকট থেকে স্বাধীন ও উম্মুক্তভাবে বাণিজ্য, খ্রিস্টধর্ম প্রচার এবং গির্জা নির্মাণের ফরমান (১৫৭৯) নিয়ে টার্ভাস বাংলায় আসেন। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ঢাকায় পর্তুগিজদের বসতি গড়ে ওঠে। পর্তুগিজরা এখানে নিজস্ব বাণিজ্যকুঠি ও উপাসনালয় নির্মাণ করেন। ষোলশতকে পর্তুগিজ ক্যাথলিক অগাস্টিনিয়ানরা হিজলিতে ঐড়ষু জড়ংধৎু নামে দুটি গির্জা নির্মাণ করে। পর্তুগিজ অগাস্টিনিয়ানরা এর মতানুসারী একই নামে বালেশ্বর (১৬৪০), ঢাকার তেজগাঁও, হাসনাবাদ (১৭৭৭), রাঙ্গামাটি (১৬৪০), চট্টগাম (১৬০১) এবং বাকেরগঞ্জে (১৭৬৪) গির্জা নির্মাণ করে। জেমস টেলর বলেন, ঢাকার সন্নিকটে তেজগাঁও এর গির্জাটি ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে স্থাপিত। তার মতে, প্রথমে এটি ভার্থেমা (ইটালিয়ান ভ্রমণকারী) কর্তৃক বর্ণিত নেস্টোরীয় এর অনুসারী খ্রিস্টান বণিকদের দ্বারা নির্মিত হয় এবং পরবর্তীকালে রোমান ক্যাথলিক মিশনারীগণ কর্তৃক কেবল তা সংস্কার সাধিত হয় বা পুননির্মিত হয়। ১৮৪৫ সালে কোলকাতা রিভিউতে প্রকাশিত ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব ঈড়ঃঃড়হ গধহঁভধপঃঁৎব ড়ভ উধপপধ উরংঃৎরপঃ শীর্ষক প্রবন্ধে তেজগাঁয়ের গির্জাটি নির্মাণকাল ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দ বলে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে জি.জি.এ ক্যাম্পোজ গির্জাটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে বলে উল্লেখ করেন কিন্তু ম্যানরিক সেবাস্টিয় ১৬৪০ এবং টের্ভানিয়ার-এর (১৬৪০ ও ১৬৬৬) বর্ণনায় গির্জাটির উল্লেখ থাকায় ক্যাম্পোজের উক্ত মতামতটি গ্রহণ করা যায় না।
১৯৪০-৪২ সালের মধ্যে গ্রটো নামের একটি প্রার্থনাঘর নির্মিত হয় এ চার্চে। ফ্রান্সের লুদনগরে পাহাড়ের গুহায় মা মারিয়া দেখা দিয়েছিলেন কৃষকবালা জোসিনতাকে। তারপর থেকেই সে গুহায় জল উঠতে শুরু করে। সেখান থেকেই সে স্থানে প্রার্থনা করলে মনের আশা পূরণ হয় বলে কথিত আছে। আর সে গুহার আদলেই তৈরি হয়েছে এ গ্রটো। এখানে মনের আশা পূরণের জন্য প্রার্থনার পাশাপাশি দুই পাশে ভক্তির প্রকাশ হিসেবে মোমবাতি জ্বালান ভক্তরা।
গির্জাঘরের অভ্যন্তরেও ৪৩টি কবর ফলক রয়েছে। এগুলোতে লেখা রয়েছে ইংরেজি, গ্রিক ও আর্মেনীয় ভাষায়। সবচেয়ে পুরনো কবর ফলকটি ‘সোয়ামো সোয়ারেস’-এর ১৭২৫ সালের। আর্চ বিশপ হাউসে রক্ষিত নথিপত্রে এবং অ্যান্থনি চার্লস সংকলিত প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, পর্তুগিজ আগস্টানিয়ান সম্প্রদায়ভুক্ত মিশনারিরা ১৬২৮ থেকে ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বঙ্গে গির্জা পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তবে তাদের কোন কবর তেজগাঁও, নাগরী, হাসনাবাদ বা আমপট্টিতে নেই। আগস্টানিয়ানরা এসব ধর্মপল্লীতে তাদের প্রিয়জনদের কবর দিলেও পরে সেগুলোর অস্থি গোয়া বা পর্তুগালে পাঠিয়ে দিতেন। বর্তমানে এখানে কবরের সংখ্যা এক হাজারের ওপর।এটি এ উপমহাদেশের অক্ষত সবচেয়ে প্রাচীন গির্জা। নির্মাণকাজে ব্যবহৃত উপাদান বিশ্লেষণ করে জানা যায়, বর্তমান পশ্চিম দিকের মূল চ্যাপেল ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে পর্তুগিজ নির্মাণশৈলীর নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরি। বাংলাদেশে ক্যাথলিক মন্ডলী এবং আর্চ বিশপ হাউসে সংরক্ষিত নথিপত্র থেকে জানা যায়, ‘ভের্তোমান্নুস’ নামে এক ইউরোপীয় পর্যটক ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে পূর্ববঙ্গ সফরকালে এটি লিপিবদ্ধ করেন, কিছু সিরীয় খ্রিস্টান ইট-সুরকি নির্মিত গির্জায় উপাসনা করতেন। এর প্রাথমিক নির্মাতা ছিলেন ওই সিরীয় ‘নেস্তোরীয়’ খ্রিস্টানরা। জেমস টেলর লিখেছেন, ভারতের দক্ষিণে নেস্তোরীয় উপাসনালয় গুলোর সঙ্গে তেজগাঁওয়ের এ গির্জার ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য রয়েছে এবং খ্রিস্টান ব্যবসায়ীদের দ্বারা এটি নির্মিত। পরবর্তী সময়ে রোমান ক্যাথলিক মিশনারিদের দ্বারা পুনঃসংস্কার হয় ১৭১৪ সালে।
১৭৪১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার দুই হাজার ক্যাথলিক খ্রিস্টিয়ান লোকের মধ্যে তেজগাঁওয়ে ছিল ৭০০ জন। ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে করতলব খান (মুর্শিদকুলী খান) তার দীউয়ানি ঢাকা থেকে মকসুদাবাদে (মুর্শিদাবাদ) স্থানান্তরিত করার প্রভাব হলি রোজারী চার্চটির উপরও পড়ে। কারণ ঢাকার অধিকাংশ বণিক শ্রেণি মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৩৬ সালে কলকাতার ফাদার মুর এস জে ঢাকা সফরকালে হলি রোজারী চার্চটিকে অবহেলিত অবস্থায় দেখতে পান। ১৮৩৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গির্জাটির ব্যয় নির্বাহের জন্য তেজগাঁয়ের জনৈক ক্যাথলিক ফ্রান্সিস্কো ব্রাহ্মুন্ডি, করকমোড়া ও অন্যান্য গ্রাম দান করেন। ১৮৫৭ সালের ২৬ মার্চ তার পুত্র রড্রিকস্ একই উদ্দেশ্যে তেজকুনী পাড়ার অর্ধেকাংশ দান করেন। ১৯৩৬ সালে গির্জাটির জন্য স্থায়ী যাজক নিয়োগ করা হয়। ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গির্জাটির চারবার সংস্কারের কথা জানা যায়। ১৯৪৭ সালে এ এলাকাকে শিল্পাঞ্চল ঘোষণা করলে বহু খ্রিস্টান পরিবারকে চলে যেতে হয় অন্যত্র। কিন্তু তারপরও ঢাকায় খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় উপাসনালয় চার্চ হলি রোজারিও চার্চ।