সৈয়দ আবুল হোসেনের জয়
ড. মিল্টন বিশ্বাস
সৈয়দ আবুল হোসেন একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতুর বিষয়ে তদন্ত চলছে। এ অবস্থায় আমি সরকারি দায়িত্ব পালন করতে চাই না।’ এটি তার শুভবুদ্ধির পরিচয় ছিল। এর আগে তিনি সংবাদপত্রে প্রকাশিত তার খোলা চিঠিতে বৃহত্তর স্বার্থে পদত্যাগের আভাস দিয়েছিলেন। অনেকেই মনে করেছিলেন তার পদত্যাগ পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাগোষ্ঠীর অর্থায়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। আমাদের মতে, নিজস্ব অর্থায়ন যেমন যৌক্তিক তেমনি দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাও দরকার। অবশ্য তখন সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করাসহ বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে বিস্তর কথা বলা হয়ে গেছে। বিকল্প দাতাদের অর্থায়ন, বাজার খরচ বাঁচিয়ে নিজেদের টাকায়, মানুষের অনুদানে ইত্যাদি নানা পন্থায় সেতু বানানোর প্রচেষ্টার কথা বলা হয়েছিল। এক অর্থে এসবই আমাদের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের উন্মোচনের দৃষ্টান্ত ছিল। রাজনীতিবিদরা যেকোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সক্ষম এসব তারও উদাহরণ। এটা সত্য যেখানে বিশ্বব্যাংকের মতো দাতা সংস্থা পদ্মা সেতুর মতো এত বড় একটা প্রকল্পে জড়িত সেখানে শুধুমাত্র ব্যক্তি আবুল হোসেন একা দুর্নীতি প্রচেষ্টার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন না। এখন প্রমাণও হলো তিনি নির্দোষ।
আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, তার আগে বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে কি ঘটেছিল সে সব তথ্য জানা দরকার। সে সময় প্রতিটি বড় বড় দুর্নীতি হয়েছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। আওয়ামী লীগের আমলে সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক) স্বাধীন। এজন্য সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়াই অনিয়ম বা দুর্নীতির রহস্য উদ্ঘাটন করছে দুদক। এ কারণে আবুল হোসেনের ঘটনা নিয়ে ভাবার কোনো কারণ ছিল না যে, আমাদের দেশ দুর্নীতিবাজে ভরে গেছে।
একথা সকলে একবাক্যে মেনে নিতে বাধ্য যে, ৯ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৫ ডিসেম্বর ২০১১ পর্যন্ত আবুল হোসেনের যোগাযোগ মন্ত্রিত্বের প্রায় তিন বছরে পদ্মা সেতুর প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। এ সময়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে পদ্মা সেতুর ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনসহ প্রস্তুতি কাজ, মূল সেতুর প্রাক-যোগ্য দরদাতা নির্বাচন, নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়াসহ যাবতীয় কাজ সমাপ্ত হয়। এক্ষেত্রে সরকারের নিয়ম-কানুন, ক্রয়নীতি, বিধি, বিশ্বব্যাংক ও দাতা সংস্থাদের গাইডলাইন-এর আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং ভূমি অধিগ্রহণ ব্যতীত প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশ্বব্যাংকের সম্মতির পর পরবর্তী কার্যক্রম গৃহীত হয়েছিল। প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভূমি অধিগ্রহণসহ পুনর্বাসন কাজ সততা ও দ্রুততার সঙ্গে সম্পাদন করা হয়। সততা ও দ্রুততার জন্য দাতা সংস্থা এ কাজের ভূয়সী প্রশংসাও করেছিল।
তখন খোলা চিঠিতে আবুল হোসেন চ্যালেঞ্জ জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যে সাক্ষ্য দিতে পারে আমি কারও কাছে টাকা চেয়েছি এবং হক-হালাল পথ ছাড়া অন্য কোনোভাবে অর্থ উপার্জন করেছি।’ এটা ঠিক তিনি নিজের নির্বাচনি এলাকায় একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। শিক্ষা বিস্তারে তার অবদান সকলে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকেন। জনগণ ও দেশবাসীর প্রতি তার দায়বদ্ধতা প্রশ্নাতীত। এজন্যই তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।… পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা, সততা, জবাবদিহিতা ও ইন্টিগ্রিটি শতকরা ১০০ ভাগ নিশ্চিত করা হয়েছে। আমি দুদককে বিশেষভাবে অনুরোধ করব, পদ্মা সেতুর মূল কাজের ন্যায় বিশ্বব্যাংকের অভিযোগকৃত নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগ কার্যক্রম নিয়েও যেন দুদক নিরপেক্ষভাবে, সুষ্ঠুভাবে, পক্ষপাতবিহীনভাবে তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করে এবং তদন্তের ফলাফল দেশবাসীকে অবহিত করে।’ এটা ছিল তার চ্যালেঞ্জ; এটা তার নৈতিক শক্তির পরিচয়। তিনি জনগণের কাছে নিজেকে উন্মোচন করেছিলেন এবং সৎ ও সততার জয় ঘোষণায় সোচ্চার হয়েছিলেন।
ছয় বছর আগে আবুল হোসেনের পদত্যাগে কোনো দুর্নীতিই প্রমাণ হয়নি। আসলে সৈয়দ আবুল হোসেন তখন ফ্যাক্টর ছিলেন না; কোনো এক অজানা কারণে দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্রের জালে আটকা পড়ে তখনকার মহাজোট সরকার। আর সেই পরিস্থিতি থেকে বর্তমান সরকার এগিয়ে গেছে বহুদূর। ষড়যন্ত্রের জাল ভেঙে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সরকারের জন্য কঠিন হলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়েছে। সাধারণ জনগণ ভালোই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে যে, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ আওয়ামী লীগ সরকারের শ্রেষ্ঠ অবদান। ( শেষ)
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান