গ্যাং কালচার ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
ওয়াসিম ফারুক
২০১৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে নিজের চাহিদা মতো মোটর সাইকেল না পেয়ে মা-বাবার শরীরে পেট্রল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল ফারহান হুদা মুগ্ধ। হাসপাতালের বিছানায় কয়েকদিন ছটফট করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল মুগ্ধর বাবা রফিকুল হুদাকে।
সহপাঠীকে উত্যক্তের প্রতিবাদ করায় বরিশাল নগরীতে দশম শ্রেণির ছাত্র সাইদুর রহমান হৃদয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মাত্র কয়দিন আগ। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের ভাষ্যমতে, হৃদয় খুনের সঙ্গে জড়িত ছয় কিশোরকে গ্রেফতার করেছে, তারা অপরাধ স্বীকারও করেছে। হত্যার কারণ হিসেবে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রেমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি গ্যাংক গ্রুপ কিশোরদের সঙ্গে তার মতবিরোধ দেখা দেয়। সে কারণেই খেলার মাঠে খুন হতে হয় হৃদয়কে।
২০১৭ সালের যে ঘটনাটি সবাইকে অবাক করেছিল তা হচ্ছেÑ ঢাকার উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান কবির হত্যাকা-। ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় দুগ্রুপের সংঘর্ষে খুন হয় উত্তরা মাইলস্টন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র আদনান। খুনের পর পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে এক ভয়ংকর তথ্য। পশ্চিমা বিশ্বের মতো উত্তরার মতো অভিজাত এলাকায়ও বিভিন্ন নামে আছে গ্যাঙ গ্রুপ। ডিসকো ও নাইনস্টার নামের দুই গ্যাঙ গ্রুপের দ্বন্দ্বের করণেই খুন হয় আদনান। মাত্র কিছুদিন আগে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের তেজকুনি পাড়ায় খেলাঘর মাঠে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে দুই কিশোর গ্রুপের সংঘর্ষে খুন হয় আব্দুল আজিজ নামের এক কিশোর। এর অগে ক্রিকেট খেলা নিয়ে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় খুন হয় কিশোর রফিকুল ইসলাম মুন্না, আজমেরি আকাশ নামের এক কিশোর ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে মুন্নাকে।
আজকাল প্রায়ই সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে, কিশোর অপরাধের ঘটনা। তরুণ ও কিশোরদের ভয়ংকর অপরাধের চিত্র আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিয়ে তুলছে। সবার মনেই আজ প্রশ,œ তাহলে বিচারহীনতার কালচারই কি তরুণদের মনের ভিতরে অপরাধ প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে? একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের কোনো গুরুতর অপরাধের জন্য যে ধরনের বিচার হয়, শিশু-কিশোরদের বেলায় তা ভিন্ন। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ এবং বাংলাদেশের ২০১৩ সালে পাসকৃত শিশু আইন বলে, ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীরা যদি কোনো অপরাধ করে, তাহলে তাদের সাধারণ কারাগারে পাঠানো যাবে না। বড়দের মতো তাদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া যাবে না। উন্নয়ন কেন্দ্রে আটকে রেখে সেখানে তাদের মানসিকভাবে শোধন করার ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ, তারা যে গুরুতর অপরাধ করেছে, তা করা উচিত হয়নি এমন অনুশোচনা তাদের ভিতর জাগাতে হবে যেন ভবিষ্যতে তারা আর কখনো অপরাধে না জড়ায়। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের শিশু-কিশোর অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া প্রায় একই রকম। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাতে কি কিশোরদের ভিতর থেকে অপরাধ প্রবণতা কমেছে? উত্তরে আসবে সম্পূর্ণ উল্টো। বেশ কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এনামুল হক শামীমকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় র্যাব মেহেদী হাসান সৈকত নামের এক প্রফেশনাল কিশোর কিলারকে গ্রেফতার করেছিল। সৈকত সাত বছর বয়সে রাজধানীর তেজতুরী বাজার এলাকায় খেলার মাঠে রফিকুল ইসলাম নামে অপর এক কিশোরকে হত্যার মধ্য দিয়ে অন্ধকার জগতে প্রবেশ। কিশোর সংশোধনাগারেই কয়েক বন্ধুর সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে সৈকতের, সেখানেই সে অস্ত্র চালনোসহ বিভিন্ন অপরাধ সম্পর্কে ধারণা পায়। চার বছর কিশোর সংশোধনাগারে কাটানোর পর আরও ভয়ঙ্কর হয়ে বের হয়ে আসে সৈকত।
কিশোর বয়সীদের মধ্যে অন্যান্য অপরাধের প্রবণতা কমলেও খুন, ধর্ষণ এবং ধর্ষণ করার পর হত্যার মতো হিংস্র ধরনের অপরাধের প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েই চলেছে। কিশোরেরা কেন দিনদিন এত বেপরোয়া ও হিংস্র হয়ে উঠছে? এ বিষয়ে অনেক বিশেষজ্ঞরই অভিমতÑ তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের ফলে খেলাধুলা ও পারিবারিক সম্পর্ককে অনেক দূরে ঠেলে দিচ্ছে শিশু-কিশোররা। আমাদের নেতিবাচক রাজনীতিও সহায়ক হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তথাকথিত বড় ভাইরা নিজেদের পেশীশক্তিকে শক্ত করতে নানান অপকর্মে ব্যবহার করছে কিশোরদের। কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক ত্রুটিগুলো সংশোধনের পাশাপাশি অবশ্যই কিশোর অপরাধ বিচারের বিদ্যমান ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন। বড়দের মতো শাস্তি হয় না বলে অপরাধপ্রবণ কিশোরদের মনে শাস্তি হবে না এমন বোধ কাজ করে থাকতে পারে। আর সেই বোধ থেকেই হয়তো কিশোরদের ভিতর অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। তাই এখনই সময়Ñ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের যৌথ প্রচেষ্টা। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশু-কিশোররা যেন বিপথে না যায়, সুস্থ্য-স্বাভাবিক জীবনে থাকে তার দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসই পারে কিশোর অপরাধ কমতে।
লেখক: কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান