যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নীতি এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস
ডা. জাকির হোসেন
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
রিচার্ড নিক্সন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিলেন। হোয়াইট হাউসে অবস্থানকালীন রিচার্ড নিক্সন হেনরি কিসিঞ্জারের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিয়েলপলিটিকসের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৬৯-১৯৭৭ সালের মধ্যে কিসিঞ্জার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি ডিটেন্ট নীতির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন, গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আমেরিকার সম্পর্ক বজায় রাখেন। হেনরি কিসিঞ্জারের দিক নির্দেশনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলোÑ যে দেশ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলে সবসময় অন্য দেশের সমালোচনায় মুখর থাকে, এমনকি মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতেও দ্বিধা করে না, সেই দেশ সেই সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আধিপত্য বিস্তারের জেরে শুরু হয় ইতিহাস বিখ্যাত সেই শীতল যুদ্ধ। শীতল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সোভিয়েত ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের জায়গা থেকে শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। স্নায়ু যুদ্ধের শুরু থেকেই আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধু দেশগুলোকে চাপে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকাকালীন সময়ে তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই স্নায়ু যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত ইউনিয়ন চাইলে আমেরিকাকে ধূলোতে মিশিয়ে ফেলতে পারত কিন্তু তৎকালীন সোভিয়েত নেতারা তা না করে তাদের সমরশক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চেয়েছিলেন তাদের সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিপ্লব ঘটাতে। সোভিয়েতের সমর কৌশলে ভীত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র জোট তৈরি করে, আমেরিকা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নৌ-ঘাটি স্থাপন করে আটলান্টিকের পূর্ব অংশে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, যদিও এই ক্ষেত্রে তারা তেমন সফল হতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র জানত, তৎকালীন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন হামলা চালালে তারা মুহূর্তের মধ্যে হেরে যাবে। তাই তারা এবার বিশ্বব্যাপী কূটকৌশল শুরু করে তাদের গোয়েন্দাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে। আর তারই অংশ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধু দেশ, যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, সেই সকল দেশের সরকার প্রধানকে সরিয়ে নিজের অনুগত সরকার প্রধান বসানোর চেষ্টা করে। এই পদ্ধতিতে এবার তারা সফলতার মুখ দেখতে পায়।
আর এই কূটকৌশলের শিকার হতে শুরু করেন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অনেক গুণী নেতারা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বব্যাপী একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারপরও রাশিয়ার হাতে বিশাল পারমাণবিক অস্ত্রের ভা-ার মজুদ থাকার কারণে তারা সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে সোভিয়েতের পুরনো মিত্র রাষ্ট্রগুলোকে তাদের কূটকৌশলের মাধ্যমে শোষণ করার পথ বেছে নেয়। তাদের এই ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি এখনো বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ড. ইউনূসকে জড়িয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট সরকারের সঙ্গে একরকম অঘোষিথ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন যা বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়। একজন গুণী মানুষ হিসেবে তাকে রাষ্ট্রের মূল্যায়ন করা অত্যাবশ্যক। কিন্তু তদোপুরি গুণীজনকেও দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া অত্যাবশ্যক। কারণ জাতীয় স্বার্থের উপরে কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল হতে পারে না। তাই এদেশের স্বার্থে, এদেশের ষোল কোটি বাঙালির স্বার্থে আমেরিকার বৈশ্বিক ও বাংলাদেশ নীতিকে অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে মোকাবিলা করে চলাই আমাদের জন্য শ্রেয়তর।
সম্পাদনা: আশিক রহমান