পুঁজিবাজারের আচরণ কি স্বাভাবিক?
ইকতেদার আহমেদ
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ১৯৯৬ ও ২০১০খ্রিস্টাব্দে দুটি বড় ধরনের ধসের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিল। উভয় ধস পরবর্তী তদন্ত কমিটি ও মামলা হলেও বাজার কারসাজির সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা না করতে পারার কারণে তারা এখনো সক্রিয়। এরই ফলশ্রুতিতে দেখা গেছে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে একদা সাধারণ সূচক ৫ হাজার ৩শ’র কোঠায় উঠে পুনঃ ৪ হাজার ২শ’র কোঠায় নেমে আসে। একই প্রবণতার পুনরাবৃত্তি ২০১৭খ্রিস্টাব্দে পরিলক্ষিত হয় এবং সূচক একদা ৫ হাজার ৫শ অতিক্রম করে। এরপর এক সপ্তাহের ব্যবধানে সূচক প্রায় ৩শ পয়েন্ট হারালেও বর্তমানে ৫ হাজার ৪শ থেকে ৫ হাজার ৬শ এর মধ্যে উঠা-নামা করছে। বাজার মূলধন এবং বাজারের অন্তর্নিহিত শক্তি বিবেচনায় নিলে সূচকের বর্তমান অবস্থান স্বাভাবিক প্রতীয়মান হয়। কিন্তু খাতভিত্তিক কিছু কোম্পানির শেয়ারের দরমূল্য অনুপাত আয় ও মোট সম্পদ মূল্য বিবেচনায় অযৌক্তিকভাবে নিম্নে অবস্থান করার কারণে তা বাজারের স্থিতিশীলতার পথে বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশে পুঁজিবাজারের বাজার মূলধন মোট জাতীয় আয়ের কয়েকগুণ অধিক হয়ে থাকে। আমাদের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন এখনো মোট জাতীয় আয়ের এক পঞ্চমাংশে পৌঁছাতে পারেনি। এ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হলে আমাদের পুঁজিবাজারের ব্যাপক বিকাশের সুযোগ রয়েছে। যেকোনো দেশের পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে যে দুটি খাত মুখ্য ভূমিকা পালন করে সে খাতগুলো হলো মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও ব্যাংকিং খাত। এর পরের অবস্থানে রয়েছে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা খাত।
আমাদের মিউচ্যুয়াল ফান্ডসমূহের একটি বড় অংশের শেয়ার দর অভিহিত মূল্যের নিম্নে অবস্থান করছে যদিও এ সকল মিউচ্যুয়াল ফান্ড নিয়মিত ৫-১০% হারে নগদ অথবা স্টক লভ্যাংশ দিয়ে যাচ্ছে। অনুরূপ ব্যাংকিং খাতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কোম্পানির শেয়ার দর দীর্ঘদিন যাবৎ অভিহিত মূল্যের নিচে অথবা একটু উপরে অবস্থান করছিল। ব্যাংকিং খাতের কোম্পানিসমূহ বিগত কয়েক বছর যাবৎ যে হারে নগদ ও স্টক লভ্যাংশ দিয়ে আসছে তাতে কোনো ব্যাংকের শেয়ার দর অভিহিত মূল্যের তিন গুণের নিচে থাকার কথা নয়। এখানেও দেখা যাচ্ছে একই ধরনের লভ্যাংশ দেওয়ার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দুটি ব্যাংকের শেয়ার দর অভিহিত মূল্যের ছয় গুণ ও দশ গুণ অধিক। এ দুটি ব্যাংকের মূল্য অনুপাত আয় এবং মোট সম্পদ মূল্য বিবেচনায় নেওয়া হলে অপরাপর ব্যাংকের শেয়ার দরের সঙ্গে এ দুটি ব্যাংকের শেয়ার দরের এত অধিক তারতম্য থাকার কথা নয়।
বর্তমানে আমাদের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক মেয়াদি আমানতের ওপর বাৎসরিক সাড়ে ৩% থেকে ৫% সুদ প্রদান করে থাকে। এর বিপরীতে ব্যাংকসমূহ হতে কেউ ঋণ নিতে চাইলে দেখা যায় সুদের হার আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ব্যাপ্তি (ঝঢ়ৎবধফ) ৫ অতিক্রম করে ৬/৭ অবধি বিস্তৃত। দেশের সাধারণ মানুষ মেয়াদি আমানতের ওপর এ ধরনের স্বল্প সুদে ব্যাংকে মেয়াদি আমানত রাখার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কিন্তু বিকল্প অন্য কোথাও নিরাপদ বিনিয়োগের অনুপস্থিতিতে সাধারণ জনমানুষ ব্যাংক হতে মেয়াদি আমানত উত্তোলনপূর্বক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ঝুঁকি নিতে একেবারেই অনীহ।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘ মেয়াদের জন্য শেয়ার ক্রয় করে থাকে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে সমআচরণ করছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নিকট হতে এ ধরনের আচরণ প্রত্যাশিত হলেও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিকট হতে কখনো প্রত্যাশিত নয়। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বিশেষত যে সকল ব্যাংকিং কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পাশাপাশি বাজারের সদস্য তাদের অনেকের ২০১০খ্রিস্টাব্দের ধস পূর্ববর্তী পুঁজিবাজার হতে আয় অন্যান্য সকল খাতের আয় হতে অধিক ছিল। যেকোনো দেশে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে পুঁজিবাজারে সদস্য বাণিজ্যিক ব্যাংক অন্যান্য খাতের চেয়ে যদি পুঁজিবাজারকে অর্থ আহরণের সহজ পথ হিসেবে বেছে নেয় সেক্ষেত্রে তা পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা এবং ব্যাংকিংখাতের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশে এ প্রবণতাটি আমরা ইতোমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু তারপরও দেখা যায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে ব্যাংকসমূহের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিদের বোধদ্বয় হয়নি।
আমাদের বেশকিছু মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে দেখা গেছে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ না করে বিভিন্ন ব্যাংকে মেয়াদি আমানত হিসেবে বিনিয়োগ করেছে। এ ধরনের বিনিয়োগ আইনগতভাবে বারিত না হলেও নৈতিকতার দিক হতে সমর্থনযোগ্য নয়। এখন বাধ্য হয়েই বিভিন্ন ব্যাংকে বিনিয়োগকৃত মেয়াদি আমানত উত্তোলনপূর্বক তারা পুনঃ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে। এ সকল মিউচ্যুয়াল ফান্ড প্রারম্ভিক বিনিয়োগের সময় ব্যাংকে মেয়াদি আমানতে বিনিয়োগের পরিবর্তে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে তাদের মুনাফার অংক অধিক হতো এবং তারা নিজেরাসহ শেয়ারহোল্ডাররা অধিক লাভবান হতো।
আমাদের পুঁজিবাজারের কিছু সংখ্যক চিহ্নিত সদস্যের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা উভয় বড় ধরনের ধস, ২০১৪ ও বর্তমানের উলম্ফনে রহস্যজনক। এরা সক্রিয়ভাবে এখনো ইনসাইডার ট্রেডিং এর সঙ্গে জড়িত এবং ইনসাইডার ট্রেডিং এর মাধ্যমেই তারা স্বল্প পুঁজির বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দর অযৌক্তিক উচ্চতায় তোলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অযৌক্তিক মূল্যে শেয়ার ক্রয়ে প্রলুব্ধ করে। সঙ্গত কারণেই মৌল ভিত্তি দুর্বল হওয়ার কারণে এ সকল শেয়ারের দর স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অনেকেই এদের কারসাজির গোপন রহস্য না বোঝার কারণেই প্রতিনিয়ত তারা এদের দ্বারা মুলধন হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে।
আমাদের পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করাসহ পুঁজিবাজারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে এনে সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে হলে বিভিন্ন মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ব্যাংকিং কোম্পানি, বীমা কোম্পানি এবং নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্বশীল হতে হবে। পুঁজিবাজারের সদস্য হিসেবে এদের আচরণ দায়িত্বশীল না হওয়ার কারণেই আজ বিভিন্ন মিউচ্যুয়াল ফান্ডের শেয়ারের দর অযৌক্তিকভাবে অভিহিত মূল্যের নিম্নে অবস্থান করছে। আবার বিভিন্ন ব্যাংকের শেয়ার দর অভিহিত মূল্যের সামান্য ঊর্ধ্বে অবস্থান করলেও কাক্সিক্ষত অবস্থানের অনেক নিম্নে। এ দুটি খাতের শেয়ার দর যৌক্তিক পর্যায়ে এসে তথায় স্থিতিশীল হলে আশা করা যায় পুঁজিবাজারের আচরণ স্বাভাবিক হওয়ার পথের প্রতিবন্ধকতাসমূহের অবসান ঘটবে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান