বাংলা ভাষা ও মুসলিম সংস্কৃতি
মাহবুবুর রহমান নোমানি
মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দান করেছেন ভাষাজ্ঞান। পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা অগণিত। প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে পৃথিবীতে ২ হাজার ৭৯৬ টি ভাষা প্রচলিত রয়েছে। তবে ভাষার প্রকৃত পরিসংখ্যান আজও নির্ণীত হয়নি। অঞ্চলভেদে ভাষার পরিবর্তন হয়। ভাষার এই পরিবর্তনে রয়েছে মহান ¯্রষ্টার কুদরতের বিস্ময়কর নিদর্শন। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে এরশাদ হয়েছে ‘তার এক নিদর্শন হলো তোমাদের বর্ণ ও ভাষার বৈচিত্র।’ (সুরা রোম : ২২) ভাষা উচ্চারণের যন্ত্রপাতি তথা জিহ্বা, ঠোঁট, তালু ও কণ্ঠনালী পৃথিবীর সব মানুষের অভিন্ন। অথচ সবার ভাষা এক নয়।
আমরা বাংলাদেশী। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের অহঙ্কার ও গর্বের ভাষা। দেশমাতৃকার জন্য আত্মত্যাগ ও প্রাণ উৎসর্গের ঘটনা ইতিহাসে অনেক থাকলেও নিজ মাতৃভাষার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়ে শাহাদাতের অনন্য মর্যাদা লাভ করেছে এমন নজির বাংলাভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষার ভাগ্যে জুটেনি। তাই এই ভাষা লাভ করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার গৌরব। প্রতি বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি পালিত হয় বিশ্ব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই মর্যাদা ধরে রাখা আমাদের দায়িত্ব।
বাংলা ভাষার স্বকীয়তা জিইয়ে রাখা এবং বিশুদ্ধ বাংলাভাষা চর্চা করা সবার কর্তব্য। বাংলা ভাষায় কথা বলার সময় ইংরেজির শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটানো দূষণীয়। যেমন, বাংলা ভাষায় কথা বলার মাঝে মাঝে ‘সো, বাট, বিকজ’ ইত্যাদি ইংলিশ শব্দ ঢুকিয়ে দেওয়া। এতে মাতৃভাষার স্বাতন্ত্র যেমন নষ্ট হয় তেমনি নতুন প্রজন্মের অন্তরে বিদেশি ভাষার প্রতি আগ্রহ জন্মে। বর্তমানে নামের ক্ষেত্রেও ইংরেজি শব্দের প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। যেমন, প্রিন্স, জর্জ, লিংকন প্রভৃতি। আরেকটি বিষয় ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা হলো, আক্ষেপ ও বিস্ময় বুঝানোর ক্ষেত্রে বলা হয়, ‘ও মাই গড’। মুসলমান হিসেবে এ ক্ষেত্রে ‘সুবহান আল্লাহ’ কিংবা ‘ইন্নালিল্লাহ’ বলা উচিত। কেননা ‘গড’ শব্দ কখনও ‘আল্লাহ’ শব্দের প্রতিশব্দ হতে পারে না। ‘গুড মর্নিং’ গুড আফটার নোন, গুড নাইট’ এ জাতীয় সংস্কৃতি পরিত্যাগ করা উচিত। এগুলো আদৌ ‘আসসালামু আলাইকুম’ (তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক) এর সমপর্যায়ের হতে পারে না।
ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পরিবর্তে ‘থেঙ্ক ইউ’ স্বাগতমের জায়গায় ‘ওয়েলকাম’ দুপরের খাবার না বলে ‘লান্স’ বলা বাংলাভাষার প্রতি অবহেলা নয় কি? আমাদের উচিত নিজেদের স্বকীয়তা ও আত্মপরিচিতি ধরে রাখার জন্য মাতৃভাষার যথোপযুক্ত ব্যবহার। পৃথিবীর যে কোনো অঞ্চলের লোকের কাছে তার মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম।
মাতৃভাষার প্রতি মানুষের অনুরাগ মজ্জাগত এবং চিরকালীন। তাই মাতৃভাষা শিক্ষা ও চর্চার প্রতি ইসলামের রয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন। ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সা. ছিলেন আরবিভাষী। তিনি তাঁর মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, ‘তোমরা আরবিকে ভালবাসো, যেহেতু আমি এ ভাষার নবী।’ তিনি ছিলেন আরবের সবচেয়ে সুন্দর বিশুদ্ধভাষী। ভাষা ও সাহিত্যে সর্বাধিক নৈপুণ্যের অধিকারী। তিনি বলেছেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ ভাষার অধিকারী।’ মহানবী সা. এর মুখনি:সৃত কথা ছিল সাহিত্যের মানদ-ে অত্যন্ত উঁচু মাপের। তার বক্তৃতা ও বাচনভঙ্গি ছিল অতুলনীয়। তাঁর রেখে যাওয়া হাদিসের ভা-ার এবং ঐশীগ্রন্থ আল কোরআনের ভাষা আরবি সাহিত্যের সর্বোচ্চ স্থান দখল করে আছে। রাসুল সা. শৈশবেই বিশুদ্ধ আরবি ভাষা শিক্ষা করেছিলেন এবং বিশুদ্ধ ও স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলতেন, যা শোনে লোকজন আশ্চর্য হয়ে যেতো। মাতৃভাষা চর্চা করা এবং তাতে দক্ষতা অর্জন করা নবীদের সুন্নত।
এর সমর্থন পাওয়া যায় পবিত্র কোরআনে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকে তার স্বজাতির ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছি।’ [সুরা ইবরাহিম : ৪] আসমানি প্রসিদ্ধ চারটি কিতাব চার ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। দাউদ আ. এর প্রতি জবুর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে ইউনানী ভাষায়, যা তার জাতির ভাষাছিল। মুসা আ. এর ওপর তাওরাত অবতীর্ণ হয়েছে হিব্রু ভাষায়, যা ছিল ইহুদিদের মাতৃভাষা।
ঈসা আ. এর প্রতি অবতীর্ণ ইঞ্জিলের ভাষা ছিল সুরয়ানি (গ্রীক), যা খ্রিস্টানদের মাতৃভাষা ছিল। আর আমাদের প্রিয়নবী সা. এর ওপর অবতীর্ণ কোরআনের ভাষা আরবি। সুতরাং মাতৃভাষার ভাষার গুরুত্ব আল্লাহর কোরআন ও বিশ্বনবী সা. এর বাণী দ্বারা স্পষ্ট অনুমেয়। স্বয়ং বিশ্বনবী সা. মাতৃভাষা হিসাবে বিশুদ্ধ আরবি ভাষা চর্চা করতেন।