ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির ইসলাম
কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক
মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে, যে জীবনের ব্যাপ্তি কেবলমাত্র পার্থিব জগতের মধ্যে সীমিত অথবা যেখানে দেহের সঙ্গে আত্মার সংযোগ নেই, ইসলাম তেমন কোনো জীবনধারায় বিশ্বাস করে না। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ উল্টো। এখানে ব্যক্তিকে আখেরাতে বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়, ভালো কিছুকে উৎসাহিত ও মন্দকে নিরুৎসাহিত করা হয় এবং ভালো কাজের জন্য পুরস্কার ও মন্দ কাজের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। এজন্য আল্লাহ ভীতি, আখিরাতে বিচার, পুণ্যবানদের জন্য জান্নাতের শান্তি ও পাপীদের জন্য ভয়ংকর শাস্তি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয় বারবার। মানুষের কার্যাবলী দু’ভাগে বিভক্তÑ ভাল ও মন্দ। আবার যে কাজ থেকে বিরত থাকা মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক সেগুলোও দু’ধরনের। এমন কিছু কাজ আছে যা পার্থিব জগতের শাস্তির পাশাপাশি আখেরাতে শাস্তি পেতে হয়। আবার এমন কিছু কাজ রয়েছে যার ইহকালীন জীবনে শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলেও পরকালে শাস্তি ভোগ করতে হয়। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে বস্তুগত আরও কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে ইসলামে। এর কারণ অন্যায় আচরণ ও অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা থেকে মানুষকে বিরত রাখা।
ইসলাম উদারতার ধর্ম, যার মূল ভিত্তি পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ। এতে জবরদস্তি ও অসহিষ্ণুতার কোনো স্থান নেই। ইসলামকে তাই শান্তি, সম্প্রীতি, উদারতা ও পরমত সহিষ্ণুতার ধর্ম বলা হয়। মুসলমানরা যুগে যুগে উদারতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বিশ্ব ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার। ইসলামে নৈতিকতার সূত্রপাত ঘটে দু’টি সূত্রে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করার মাধ্যমে এবং মানবতার জন্য যা অকল্যাণকর সেসব পরিহার করার মাধ্যমে। বর্ণ-গোত্র, ভাষা, বাসস্থানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বৈষম্যকে ইসলাম পছন্দ করে না। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেÑ ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী। আল্লাহ সবকিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন।’ [সুরা হুজরাত : ১৩]।
আজ আমাদের সমাজে সব আছে, নেই শুধু সুসম্পর্কের সবুজ আচ্ছাদন। অসহিষ্ণুতার উত্তাপে চারদিক খাঁ খাঁ করছে।
বাক্যবিনিময়ে নেই কোমলতার কোনো চিহ্ন। কথোপকথনে গালাগালের প্রাবল্য পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে। সমাজে সবসময় কিছু ব্যক্তি থাকে যাদের কথাবার্তা দুর্গন্ধময়। সব কথায় তাদের ঝগড়ার গন্ধ। তারা এতদিন ছিল ব্যতিক্রম। এখন তারাই সমাজের স্বাভাবিক মানুষ। বাংলাদেশে এই রূপান্তর অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এ দেশের মানুষ কিন্তু মিষ্টি কথা শুনতে অভ্যস্ত। ভালো কথার প্রতি তাদের দুর্বলতার অন্ত নেই। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলেও সেই অভিযোগ পেশ করা হয় গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায়। রুচিশীল এবং শালীন কথাবার্তার মাধ্যমে। অশালীন উচ্চারণ সব সময় ঘৃণ্য বলে বিবেচিত। আজ সেই বাঁধন টুটেছে। এই দুঃসময় কাটাব কীভাবে?
এ সমাজে কেউ একা থাকতে চায়নি। অনাত্মীয় পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গেও মনগড়া সম্পর্ক তৈরি করে সবাই বসবাস করেছেন। কাউকে ভাইবোন সম্বোধন করে, কাউকে বা চাচা-চাচি, আবার কাউকে দাদা-দাদি, খালা-খালু বলে ডাক দিয়ে, অনাত্মীয়কে আত্মীয় করে, একত্রে কাল কাটিয়েছেন সবাই। দেশের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সম্ভবত এই সনাতন ট্রাডিশনকে অনুসরণ করেই, সম্বোধনের ক্ষেত্রে ভাই শব্দটি প্রয়োগ করা হয়। একজন অনুজতুল্য জুনিয়র সবসময় তার সিনিয়রকে তার নামের শেষে ভাই শব্দ প্রয়োগ করেই সম্বোধন করেছেন। আজো তা বহাল রয়েছে। মোটকথা, এই সমাজে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েই সবাই বেঁচে থেকেছেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। অনাত্মীয়কে আত্মীয় করে, পরকে আপন করে, দূরকে কাছে টেনে, পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক-সূত্রে আবদ্ধ হয়ে সমাজজীবনকে বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা। সহনশীলতা এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে মূল্যবান মণি-মুক্তার মতো। কোমলতা ছিল কাঙ্খিত মূল্যবোধ। অপরের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব ছিল সামাজিক সম্পদ। উত্তেজিত না হয়ে ধীরস্থিরভাবে বক্তব্য উপস্থাপন, কারো মর্যাদা ক্ষুণœ না করে প্রতিবাদ করা, কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলেও অতি সাবধানে তা পেশ করা বরাবরই এ সমাজে প্রশংসিত হয়ে এসেছে। কারো সঙ্গে প্রথম দেখায় সালাম, আদাব জ্ঞাপন এবং কুশলাদি জানার আগ্রহ ছিল সামাজিক শিষ্টাচার। আজ যেন এর সবই নির্বাসিত। অথচ ইসলাম সামাজিক শিষ্টাচারের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। বর্ণ-গোত্র মর্যাদার পরিচায়ক নয়, বরং ইসলাম মনে করে পরহেজগারিতা, সৎকর্মশীলতা ও আল্লাহভীরুতাই একজন মানুষের পরিচয় বহন করে। যে গুণ অর্জন করতে পারলে আপন-পর ভেদাভেদ থাকবে না, পর সম্পদে লোভ আসবে না, পরমত সহিষ্ণু ও নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হওয়া যাবে।
সুতরাং মানুষের কল্যাণে আমাদের কাজ করতে হবে। ভালো কাজের জন্য ভাল ফল ও মন্দ কাজে মন্দ ফল প্রাপ্ত হতে হবে। মন্দ বা পাপ দু’ভাগে বিভক্তÑ হক্কুল্লাহ ও হক্কুল ইবাদ। হক্কুল্লাহ আল্লাহর অধিকারের সাথে সম্পর্কিত আর হক্কুল ইবাদ বান্দার অধিকার সংক্রান্ত। হক্কুল ইবাদ বা মানুষের অধিকার সংক্রান্ত পাপ করা হলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিই তাকে ক্ষমা করতে পারেন।
যখন আল্লাহর আদেশ অমান্য করা হবে তখন আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। ক্ষমা প্রদর্শন করা একটি মহৎ গুণ। ক্ষমা প্রদর্শন, উদারতা ও পরমত সহিষ্ণুতা মুমিনের জন্য জরুরি। সবশেষে ভুপেন হাজারিকার সুরে গাইতে পারি, ‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে/ একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?/মানুষ মানুষকে পণ্য করে, মানুষ মানুষকে জীবিকা করে।/পুরোন ইতিহাস ফিরে এলে, লজ্জা কি তুমি পাবে না?/বলো কি তোমার ক্ষতি? জীবনের অথৈ নদী/পার হয় তোমাকে ধরে, দুর্বল মানুষ যদি?/মানুষ যদি সে না হয় মানুষ, দানব কখনো হয় না মানুষ।/যদি দানব কখনো বা হয় মানুষ, লজ্জা কি তুমি পাবে না?’