শিবের মাদক গ্রহণ প্রসঙ্গ
সুনন্দ কেশব দাস
শিব হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গুণাবতার। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবÑ এই তিনজন গুণাবতার; কারণ তারা প্রকৃতির বিভিন্ন গুণসমূহের অধ্যক্ষতা করেন। ব্রহ্মা রজোগুণের, বিষ্ণু সত্ত্বগুণের এবং শিব এ জড়া প্রকৃতির তমোগুণের অধীশ্বর। কিন্তু তারা সকলেই ভিন্ন ভিন্ন কার্য সম্পাদনের জন্য ভগবানেরই প্রকাশ। ইসকন প্রতিষ্ঠাতা আচার্য শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীমদ্ভাগবতের তাৎপর্যে(১.৩.৫) লিখেছেনÑ ‘প্রকৃতির রজোগুণে ব্রহ্মার উৎপত্তি হয়েছিল এবং বিষ্ণু হচ্ছেন সত্ত্বগুণের অধীশ্বর কিন্তু প্রকৃতির সমস্ত গুণসমূহের অতীত বলে তিনি সর্বদাই জড় জগৎ সম্পর্কে নিষ্পৃহ। ব্রহ্মা থেকে তমোগুণের অধীশ্বর শিবের প্রকাশ। ভগবানের ইচ্ছানুসারে তিনি সমস্ত সৃষ্টির ধ্বংস করেন। তাই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবÑ এরা সকলেই গর্ভেদকশায়ী বিষ্ণুর অবতার। শ্রী বিষ্ণু পরমেশ্বর ভগবান থেকে অভিন্ন। ব্রহ্মা সর্বদাই জীব তত্ত্ব। শিব পরমেশ্বর ভগবান এবং জীবের মধ্যবর্তী তটস্থা অবস্থায় রয়েছেন।’ শিব সম্বন্ধে কিছু না জেনে অনেকেই শিব সম্বন্ধে ভ্রান্ত মতবাদ পোষণ করে নিজেদের ইন্দ্রিয়তৃপ্তির উছিলায় শিবকে গাজাখোর, শ্মশ্মানচারী, দিগম্বর বলে আখ্যায়িত করে নিজেরা তার অনুকরণ করে। এসব তথাকথিত শিবসাধকের প্রভাব পড়েছে সমাজের সাধারণ মানুষের ওপর, যারা সত্যাসত্য বিচার না করেই এ মতবাদকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। শিবের এক নাম আশুতোষ, অর্থাৎ তিনি অল্পতেই সন্তুষ্ট হন। তার ভক্তরা যখন তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য কোনো বাসনা নিয়ে তার আরাধনা করেন, তখন শিব তাদের বাসনা পূর্ণ করেন। ফলশ্রুতিতে সে সকল তমোগুণাচ্ছন্ন লোকদেরও ধমের্র প্রতি অনুরাগ জন্মায়। তখন তারা ক্রমান্বয়ে ভগবদ্ভক্তির উন্নত সিদ্ধান্তসমূহকে গ্রহণ করে ভক্তিমার্গে উন্নতি লাভ করেন। অন্যথায় সে সকল লোকদের কখনোই ভগবানের প্রতি বিশ্বাস জন্মাত না। আবার শিব বৈষ্ণব হিসেবে বৈরাগ্যের মূর্ত প্রতীক। তিনি সর্বদা ভগবান শ্রীহরির গুণকীর্তনে মগ্ন থাকেন এবং নিজেকে ভগবানের দাস অভিলাষ করেন। তাই তিনি এ জগতের সকল উৎকৃষ্ট বস্তুসমূহ ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে অর্পণ করেন, আর জগতের নিকৃষ্ট বস্তুসমূহকে তিনি তার সেবায় গ্রহণ করেন। কারণ তার প্রভুকে ভক্তরা যে উৎকৃষ্ট বস্তুসমূহ অর্পণ করেন, ভগবানের দাস হিসাবে সেগুলো কীভাবে তার নিজের সেবায় গ্রহণ করবেন।
তাই তিনি সব উত্তম বস্তু ভগবানের সেবার জন্য রেখে গাজা, ভাং ও মাদকদ্রব্য তিনি গ্রহণ করলেন, আবাসের জন্য বেছে নিলেন শ্মশ্মান, বসন হিসেবে বেছে নিলেন ব্যাঘ্রচর্ম, পুষ্প হিসেবে বেছে নিলেন ধুতুরাকে। ঠিক যেমন সমুদ্রমন্থনকালে যখন হলাহল বিষ উত্থিত হলো, তখন সেই বিষের প্রভাবে সমগ্র সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন জগৎকল্যাণের জন্য তিনি স্বয়ং সেই হলাহল বিষ তার কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠ নাম প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তার অর্থ এই নয় যে, তিনি ইন্দ্রিয়তৃপ্তির জন্য এই বিষ খেয়েছিলেন বরং সৃষ্টি রক্ষার মানসে তিনি এ কার্য বিনা সংকোচে সাধন করেছিলেন। তাই এ সমস্ত নিকৃষ্ট বস্তুসমূহও শিব তার ইন্দ্রিয়তৃপ্তির জন্য গ্রহণ করেন না, কেবল ভগবদ্সেবার জন্যই তিনি সকল প্রতিকূল বিষয় স্বীকার করেছিলেন। শিবের অনুকরণ করার ছলে সাধারণ মানুষের মাদক গ্রহণ করা উচিত নয়। হলাহল বিষের এক বিন্দুও সমগ্র সৃষ্টির জন্য ছিল প্রচ- ঝুকিস্বরূপ, কিন্তু শিব তা কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। অমাদের সেই সামর্থ্য নেই।
বিষেও শিবের যেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি, তেমনি জীবের তমোগুণ হরণের ছলে মাদক গ্রহণ করলেও তিনি জনসাধারণের মতো আসক্ত হয়ে তা গ্রহণ করেন না এবং তাতে তার কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও হয় না। সেজন্য শিবের অন্ধ অনুকরণ বা সমালোচনা না করে অন্তর্নিহিত ভাবকে উপলব্ধি করতে পারলে পরম মঙ্গলময়, বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ শিবের কৃপায় হৃদয়ের তমোগুণ থেকে মুক্ত হয়ে ভগবদ্ দাসে পরিণত হওয়া যায়। তাই শিব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যে ধারণা, তা সম্পূর্ণ ভুল। ভগবানের প্রসাদেই তার পরম তৃপ্তি এবং তিনি তার পঞ্চমুখে নিরন্তর ভগবানের স্তব করছেন।