সাঁওতালী (রোমান) বর্ণমালায় প্রাক-প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক রচনার দাবি সাঁওতাল নেতাদের
প্রভাত টুডু
আদিবাসী সাঁওতাল শিশুদের নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক রচনার ক্ষেত্রে সাঁওতালী বর্ণমালা ব্যবহারের দাবিতে ১৭ ফেব্রুয়ারী, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
যৌথভাবে মানববন্ধন আয়োজন করে ‘আদিবাসী সাঁওতাল ফেলোসিপ ও সমিতি’, ‘সান্তাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (সাসু)’, ‘সান্তাল রানাজট সমিতি’ ও সাঁওতাল লেখক ফোরাম-বাংলাদেশ।
আদিবাসী সাঁওতাল ফেলোসিপের সহ-সভাপতি যতীন মারান্ডীর সভাপতিত্বে ও সাঁওতাল লেখক ফোরাম-বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক প্রভাত টুডুর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সান্তাল রানাজট সমিতির সভাপতি বনিফাস হেমব্রম, সান্তাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (সাসু)’ সভাপতি তার্সিসিউস হাঁসদা তপু, সাধারণ সম্পাদক সুমন মাইকেল মুরমু, আদিবাসী সাঁওতাল ফেলোসিপের সম্পাদক এবং লেখকও গবেষক মিথুশিলাক মুরমু, সাঁওতাল নেতা যতীন মারান্ডী, প্রফুল্ল টুডু, এনোস হেমব্রম,লেখক ও গবেষক সুবোধ এম বাস্কে, তাবিথা সংবাদের সম্পাদক স্টেফান সরেন, আদিবাসী সমন্বয় পরিষদের সভাপতি মি. কর্ণেলিয়াস মুরমু, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি মি. হিংগু মুরমুসহ আরও অনেকে।
বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার মাতৃভাষায় আদিবাসী শিশুরা প্রাক-প্রাথমিক স্তরে পড়ালেখা করবে, শিখবে এ উদ্যোগ প্রসংশিত কিন্তু কতিপয় ব্যক্তি বা সংগঠণের কারণে আপনারা যদি সাঁওতাল (রোমান) বর্ণমালা ব্যতীত অন্য কোন বর্ণমালা ব্যবহার করে প্রাক-প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন; তাহলে সাঁওতাল জনগণ জীবন দিয়ে হলেও তা রক্ষা করবে। কারো মাতৃভাষার ওপর প্রভাব খাটিয়ে কোন কিছু জোর করে চাপিয়ে দিলে সেটা হবে বাহান্ন’র ভাষা আন্দোলনের মূলনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত এবং সেদিনের সে সকল ভাষা সৈনিক ও শহীদদের অপমানের সামিল।
এসময় বক্তারা অভিযোগ করে বলেন, কতিপয় বুদ্ধিজীবী ও কিছু দালাল সংগঠন তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য সাঁওতালী ভাষাকে বিকৃত করে বাংলা হরফ আবার কখনও অলচিকি হরফ ব্যবহারের যুক্তি খাড়া করে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাঁওতাল শিশুদের পাঠ্য-পুস্তক রচনা করার অপচেষ্টা চালিয়ে ছিল। যার জন্য সাঁওতাল জনগণের মধ্যে দ্বিধা বিভক্তি সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তাদের সেই অপচেষ্টা সাঁওতাল জনগোষ্ঠী রুখে দিয়েছে। তাদের অপচেষ্টার কারণে অন্য পাঁচটি আদিবাসীদের (গারো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ওরাঁও) প্রাক-প্রাথমিক পাঠ্য পুস্তক প্রণীত হলেও সাঁওতাল জনগোষ্ঠির পাঠ্য-পুস্তক এখনো প্রকাশিত হয়নি। আজ সাঁওতাল জনগোষ্ঠির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা আজ সংগঠিত হয়েছে। তারা আরও বলেন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উদ্যেগে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষায় পড়ালেখা করার জন্য সর্বপ্রথম ১৯৯৯ সালে রাজশাহী জেলার অর্ন্তগত গোদাগাড়ী উপজেলার বর্ষাপাড়া ও সুন্দরপুরে দুটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়।
সে স্কুল দুটিতে বাংলা হরফ ব্যবহৃত পাঠ্যপুস্তক দ্বারা পড়ানো হয়, কিন্তু বর্তমানে বিদ্যালয় দুটির করুণ অবস্থা। প্রথম দিকে সাঁওতাল জনগোষ্ঠি তাদের এ প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানালেও পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহারের ফলে সাঁওতালী ভাষা বিকৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছে এবং তা বন্ধ করারও দাবি করছে। তাদের হাতে থাকা রোমান হরফে রচিত বিভিন্ন শ্রেণীর বই (পাহিল পুথি, বাডাইজং হর প্রভৃতি), ব্যাকরণ বই, গল্পের বই, সাঁওতালি অভিধান দেখিয়ে দাবি করেন যে, আমরা ১৭২ বছর আগে থেকেই এ বর্ণমালার (রোমান) সাথে পরিচিত। রোমান হরফকে আমরা আমাদের সাঁওতালি হরফ হিসেবেই গ্রহণ করেছি। এছাড়া এ বর্ণমালায় পাঠ্যপুস্তক রচিত হলে বাংলাদেশের সাঁওতাল জনগোষ্ঠিসহ ভারত, নেপাল, ভুটানের সাঁওতালরা পড়তে ও বুঝতে পারবে। তাছাড়া এটি ইংরেজী ভাষার কাছাকাছি বলে আমাদের শিশুরা আর্ন্তজাতিক ভাষাও সহজে শিখতে পারবে।
বক্তারা আরো বলেন, আমরা বাংলা ভাষা কিংবা বাংলা বর্ণমালার বিদ্বেষী নয়; কিন্তু বিষয়টা হলো এ বর্ণমালা ব্যবহৃত হলে সাঁওতালি ভাষার কিছু কিছু শব্দসমূহের উচ্চারণ বিকৃত হয় যা সাঁওতাল লোকদের নিকট একটি বিরক্তিকর বিষয়।
সরকারকে উদ্দেশ্য করে বক্তারা বলেন, বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার মাতৃভাষায় আদিবাসী শিশুরা প্রাক-প্রাথমিক স্তরে পড়ালেখা করবে, শিখবে এ উদ্যোগ প্রসংশিত কিন্তু কতিপয় ব্যক্তি বা সংগঠণের কারণে আপনারা যদি সাঁওতাল (রোমান) বর্ণমালা ব্যতীত অন্য কোন বর্ণমালা ব্যবহার করে প্রাক-প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন; তাহলে সাঁওতাল জনগণ জিবন দিয়ে হলেও তা রক্ষা করবে। কারো মাতৃভাষার ওপর প্রভাব খাটিয়ে কোন কিছু জোর করে চাপিয়ে দিলে সেটা হবে বাহান্ন’র ভাষা আন্দোলনের মূলনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত এবং সেদিনের সে সকল ভাষা সৈনিক ও শহীদদের অপমানের সামিল। তাই কতিপয় ব্যক্তি, সংগঠনের স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে পুরো সাঁওতাল জনগোষ্ঠির ১৭২ বছর ধরে চলা অর্থাৎ যে বর্ণমালা তারা নিজেদের বর্ণমালা হিসেবে গ্রহণ করেছে সাঁওতালি (রোমান) বর্ণমালা এবং সে বর্ণমালায় পাঠ্যপুস্তক রচনার পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। না হলে বাংলাদেশের সাঁওতাল জনগণ আপনাদেরকেও ক্ষমা করবে না।
এসময় বক্তারা দ্রুত সাঁওতাল শিশুদের মাতৃভাষা অবিকৃত অবস্থায় রেখে শিক্ষা কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সাঁওতালী (রোমান) বর্ণমালায় প্রাক-প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক রচনা করে দ্রুত বাস্তবায়নের জোর দাবি জানান।
উল্লেখ্য যে, এসময় মানববন্ধনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাঁওতাল নেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন এবং বিএন ই এল সি-সাহিত্য বিভাগ, তাবিথা সংবাদ, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম, সাঁওতাল সমন্বয় পরিষদ, আদিবাসী মুক্তিমোর্চা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ওঁরাও ছাত্র সংগঠণ, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠণ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠণ একাত্বতা ঘোষণা করেন। সংগঠণগুলো একটি স্মারকলিপি যৌথভাবে এবং আলাদা আলাদা সংগঠনের পক্ষ থেকে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী, সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক ও বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি-ডিরেক্টর বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করবে বলে জানিয়েছেন।