সুশীলসমাজ বিনির্মাণে সুনাগরিকের দায় কী?
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
রাষ্ট্রের সকল মানুষই রাষ্ট্রের নাগরিক। কিন্তু সুনাগরিক কিনা সেটা একটি প্রশ্ন। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। অর্থাৎ একজন নাগরিক রাষ্ট্রকে ভালোবাসবে, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় সততা নিবেদিতপ্রাণ, একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সকল নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবে। রাষ্ট্রের অকল্যাণ হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকবে। রাষ্ট্রের সংকট, দুর্যোগে অগ্রণী সেনার ভূমিকা পালন করবে। রাষ্ট্রের সুখ-দুঃখকে নিজের সুখ-দুঃখ হিসেবে বিবেচনা করবে। রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সঙ্গে নিজের অস্তিত্বের সম্পর্ককে নিবিড় সম্পর্কে সম্পর্কিত করবে। রাষ্ট্রের কাছে সকল মানুষই দায়বদ্ধ। কিন্তু নাগরিক গুণাবলি বিসর্জন দিয়ে যদি একান্ত স্বার্থপরায়ণতা ও লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে, খেয়াল খুশিমতো, স্বেচ্ছাচারিতা মদদপুষ্ট হয়ে তাহলে সমাজ বা রাষ্ট্র কোনো রকমে হয়তো টিকে থাকবে কিন্তু মাথা উঁচু করে বিশ্বের সমাজে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না। তার ভিত হবে খুব নড়বড়ে। যেখানে সামান্য আছড়েই ধস নেমে আসবে।
আধুনিক সামর্থ্যবান যে সুশীল সমাজের কাছে বরাবর নির্জীব হয়ে থাকবে। তাকে কেউই গুরুত্ব দিয়ে আমন্ত্রণ জানাবে না বা সম্মানের কাতারে বসাবে না। তিনি হবেন অপমানিত, অবহেলিত ও দলিতদের দলের। এক্ষেত্রে দেশপ্রেমের কোনো বিকল্প নেই। দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে সুশীলসমাজ গঠনে মনোনিবেশ করতে হবে। সকল দেশপ্রেমিক মানুষই সুশীলসমাজের প্রতিনিধিত্ব করবেন। কাজেই সুশীল সমাজেই সক্রিয় কল্যাণকর রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে থাকে। সুশীল সমাজের মানুষেরা হয় সু-শিক্ষিত, স্ব-শিক্ষিত, রুচিশীল, সত্যবাদী, বিবেচক ও সংস্কৃতিসেবী। অধিকন্তু সুশীলসমাজের মানুষেরা হয়ে থাকেন সহনশীল, সহমর্মী ও সমব্যথী। দয়া, মায়া, ভালোবাসার প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত থাকে সুশীলসমাজের মানুষের মনের মধ্যে। সুশীলসমাজের মানুষেরা সভ্য ও সুনাগরিক হয়ে থাকেন। আর সুনাগরিকের গুণাবলিতে ভূষিত হতে পারলেই আধুনিক সভ্য ও সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।
আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম দেশে সরকারি চাকরিতে কর্মরত কর্মকর্তাগণকে সুশীল সেবক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশের এই সুশীল সেবকগণ কতটা নিস্কলুষ সেবা উপহার দিয়ে থাকেনÑ সেটি একটি বড় প্রশ্ন অথবা দিয়ে থাকলে সেটা গুণগত দিক থেকে কতটা কাক্সিক্ষত মানের তা আজ আমাদের উপলব্ধি করার সময় এসেছে। সেই বোধ ও বুদ্ধির জাগরণ হলেই তারা হবেন সত্যিকারের সুশীল সেবক। আর তাদের কৃতকর্মই জাতির মধ্যে এক নাগরিক চেতনার মহাজোয়ার সৃষ্টি হতে পারে। নাগরিক বোধে উদ্বুদ্ধ মানুষরাই সুনাগরিকের আসনে আসীন হন। এক্ষেত্রে গ্রাম আর নগরবাসীর মধ্যে কোনো ভিন্ন ভাবনা থাকতে পারে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা সমাজ বিনির্মাণে গ্রাম আর নগরকে একই মিশন ও ভিশন এর মন্ত্রে উজ্জীবিত করাই হলো নাগরিকের সঠিক দায়িত।
উন্নয়ন ভাবনায় ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থাকলেও নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে কোনো ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম পরিলক্ষিত হওয়ার সুযোগ নেই। সুশীল সমাজে জনগণই হচ্ছে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। জনগণের অংশীদারিত্ব, প্রতিনিধিত্ব ও সর্বোপরি জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যাবতীয় কর্মকা- পরিচালিত হলেই সমাজ হবে পীড়ন ও দুঃশাসনমুক্ত। সমাজের সকল কাজেই বৈধতা থাকতে ও সমাজের গতিপ্রকৃতিতেও বহুমাত্রিকতা আসবে। অধিকন্তু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেহারাও প্রস্ফূটিত হবে এবং কালক্রমে সমাজ, আদর্শ ও সুশীল সমাজের ক্যাটাগরিভুক্ত হবে। এই আদর্শ ও সুশীল সমাজ গঠনে আমাদের নাগরিকদের কি গ্রাম, কি শহর সর্বত্রই সুনাগরিকের মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে।
লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক ও কমান্ডান্ট, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি একাডেমি, গাজীপুর
সম্পাদনা: আশিক রহমান