বাবুল আক্তারের ফেসবুক স্ট্যাটাস সবাই বিচারক, আর আমি তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই খুনি
আজাদ হোসেন সুমন: বহুল আলোচিত এসপি পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের মধ্যে অন্যতম অভিযোগ হচ্ছেÑ তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন না। গতকাল বাবুল আক্তার নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাসে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছেন। তার মূল বক্তব্য পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলোÑ
‘অনেকের অনেক জানতে চাওয়া আমার কাছে। আমি কথা বলার জন্য মানসিকভাবে কতটা প্রস্তুত তা নিয়ে কারও বিকার নেই। তবে আমার নিরুত্তর থাকার সুযোগটুকু কাজে লাগিয়ে মনের মতো কাহিনী ফাঁদতে ফাঁদতে পরকীয়া থেকে খুন পর্যন্ত গল্প লেখা শেষ করে ফেলেছেন অনেকে। আমি আমার মা হারা সন্তান দুটোকে নিয়েই ব্যস্ত এখন। তাছাড়া প্রমাণের দায়িত্ব যারা অভিযোগ করেন তাদের। তবে আমার পরিবার পরিজন এবং শুভাকাক্সক্ষীদের কথা ভেবে কিছু কথা না বললেই নয়। শেষ থেকেই শুরু করি। ওই শেষটা যেখান থেকে আমার আর আমার সন্তানদের সব গ্লানির শুরু। বাচ্চা দুটো হয়েছে তাদের মায়ের মতো। ছিমছাম সাজানো ঘর ছেড়ে ঢাকায় বাবার বাড়ি বেড়াতে আসলে মিতু চট্টগ্রামে নিজের বাসায় ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠত। ছেলেমেয়ে দুটোও কিছুদিনের মধ্যেই নানার বাড়ি ছাড়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু সন্তান আমার হলেও তাদের উপর নানা-নানীর অধিকারটুকু আমি বিলীন করতে চাইনি। ভেসে যাওয়ার দিনগুলোতে তারা (আমার শ্বশুরপক্ষ) আমায় আর আমি তাদের আকড়ে ছিলাম। আমরা বাসায় ক্যাবল লাইন রাখা মোটেও পছন্দ করতাম না। আর মিতু মারা যাওয়ার পর থেকে নানার বাড়িতে তার বাচ্চাদের দিন শুরু হতো স্টার জলসা দিয়ে, শেষও হতো স্টার জলসা দিয়ে। ছেলে শাকসবজি খেতে পছন্দ করলেও মাসে দুই-একবারের বেশি তা খাওয়া হতো না। অন্যের বাড়িতে বাচ্চার ক্ষুধা আর স্বাস্থ্যের তাগাদা দেওয়ার সুযোগ আমার ছিল না। তবুও আমি চুপ ছিলাম, কৃতজ্ঞ ছিলাম। আমার ছেলেটার চোখের সামনে তার মা খুন হয়েছে। নিয়মিত কাউন্সিলিং করিয়েছি তাকে। কাউন্সিলরের একটাই কথা কোন অবস্থাতেই ছেলের সামনে তার মায়ের মৃত্যু সংক্রান্ত কোনো কথা বলা বা তাকে এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। ছয়টা মাস আমি চব্বিশ ঘণ্টা ছেলেটার পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। তবে বাইরে একদম না বের হয়ে তো পারা যেত না। যেদিনই বাইরে যেতাম ফিরলে দেখতাম। ছেলে বলে ‘নানা-নানী সারাদিন আম্মুর কথা বলে আমার খুব কান্না আসে। কিন্তু কান্না করতে পারি না, আমার বুকে ব্যথা করে। তারপর আমাকে বলল যেন তাকে চট্টগ্রামের বাসার মতো সুন্দর বাসায় নিয়ে যাই, দুমাসের মধ্যেই।
ছেলের নানার বাড়িতে অস্বস্তি হওয়ার অনেক কারণ ছিল। আমার শ্বশুরবাড়িতে যৌথ পরিবার। অর্থাৎ, আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, আমার শ্যালিকা ও তার স্বামী, আমার শ্বাশুড়ির নিজের বোন এবং সেই বোনের স্বামী-সন্তানসহ মোট তিনটি পরিবার আমার শ্বশুরের চার বেডরুমের ঘরটিতেই থাকে। আমার শ্বশুরপক্ষের জামাতারা নিজের শ্বশুর-শ্বাশুড়ি নিয়ে শ্বশুর ঘরেই থাকে, এটা তাদের পারিবারিক রীতি (যাতে আমি অভ্যস্ত নই)। সবদিক বিবেচনা করে আমি শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে জানালাম যে বাচ্চারা এই পরিবেশে অনভ্যস্ত এবং থাকতে চায় না। তারা বললেন, তাদের ঘরের উপরেই আরও ঘর তৈরি করতে আমি যেন ১০ লক্ষ টাকা দিই। তারা এও বললেন, যেন আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন কেউই আমার কাছে না আসে। আমার শ্বশুর বললেন, হয় আমাকে আমার বাবা-মা ছাড়তে হবে, না হয় শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ছাড়তে হবে।
আমি একদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম এত রাত পর্যন্ত তারা কী পড়াশোনা করে। তখন ছেলে বলল, নানী বলেছে তাকে বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলে চান্স পেতেই হবে এবং তাই ‘ছোটআম্মু’ তাদের মধ্যরাত পর্যন্ত পড়ায়। ভাবলাম মিতুর ছোটবোন শায়লার কথা বলছে। কিন্তু পরে আবিষ্কার করলাম মিতুর সদ্য এসএসসি পাশ করা ১৬ বছর বয়সী খালাতো বোনকে (যে তার পরিবারসহ মিতুর বাবার বাড়িতেই থাকে) আমার ছেলেমেয়েকে ‘আম্মু’ ডাকা শেখানো হয়েছে এবং আমাদের সবকিছুর তদারকিও সেই বাচ্চা মেয়েটিকে দিয়ে করানো হয়। একদিন ছেলের স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে মায়ের ভূমিকায় পাশে এসে বসে মেয়েটি। বিভিন্ন সময়ে তাকে এগিয়ে দেওয়া হতো বাচ্চাদের মায়ের ভূমিকায়। রাতে ফিরে দেখতাম ছেলেমেয়ে নিয়ে সে আমার ঘরেই আছে। আমার স্ত্রী মারা যাওয়ায় আমি এতটা বিকারগ্রস্ত হইনি যে, একটা ইন্টার পড়ুয়া ১৬ বছরের বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করে আমার বাচ্চাদের ‘মা’ বানাতে হবে। তাদের একটাই কথা, শ্বশুরের বাড়িতেই নতুন ঘর বাঁধতে হবে এবং সেখানেই থাকতে হবে।
উপায়ান্তর না দেখে একটা চাকরি ও বাসা খুঁজে নিলাম। আমার শ্বশুর পক্ষকে জানিয়েই বাসা নিয়েছি এবং এতে তারা ভীষণ মনঃক্ষুণœও হয়েছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে একরাতও বাচ্চারা আমায় ছেড়ে থাকেনি। জন্মের পর থেকেই তারা রাতে আমার সঙ্গে ঘুমিয়েই অভ্যস্ত। আমাকে কয়েক ঘণ্টা না দেখলেই কেঁদে অস্থির হয় তারা। আমাকে দিনের মধ্যে কয়েকবারই বাসায় যেতে হয়, অনেক সময় ছেলেমেয়েকে নিয়েই অফিসে যেতে হয়। তাই প্রথমে আমার শ্বশুরের পছন্দমতো তার বাড়ির কাছের স্কুলটিতে ভর্তি করালেও ছেলের দিকে তাকিয়ে তাকে আবার আমার অফিসের কাছাকাছি একটি স্কুলে ভর্তি করাই।
এটাই কি আমার অপরাধ? না হয় মিতুর মৃত্যুর পর তার মা কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘১৪ বছরের সংসারে অশান্তি হয়নি বাবুল-মিতুর,।’ ‘বাবুল হইল ফেরেশতা।’ এমনকি গতমাসে (২৫ জানুয়ারি, ২০১৭) তিনি চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমি বাবুলকে সন্দেহ করি না।’ মিতুর বাবা মিডিয়ায় বলেছিলেন, ‘এসব কথা ভিত্তিহীন। তদন্ত ভিন্নখাতে নেওয়ার জন্য এসব রটানো হচ্ছে।’ আমার শ্যালিকা শায়লা বলেছিল, ‘ভাইয়া আর আপুর সংসারে কোনো অশান্তি ছিল না।’ আর কয়েকমাস গড়াতেই আজ ভিন্ন কথন! আমার অবুঝ দুই সন্তানের দিকে তাকিয়ে নাকি তারা চুপ ছিলেন। অন্তত যৎসামান্য চেষ্টাও কী কেউ করে না তার মেয়েকে সুখী করার?! আর যেই মেয়ের স্বামী পরকীয়ায় আসক্ত, যার সঙ্গে দিবানিশি অশান্তির সংসার ছিল, সে খুন হওয়ার পর আট মাসেও তার মা-বাবার একটিবারের জন্যও মনে হলো না যে স্বামীই তার হত্যাকারী?! ‘তোমারে পচাইয়া ছাড়মু, শান্তিতে থাকতে দিমু না।’Ñ কথাটি অক্ষরে অক্ষরে রাখার নিরন্তর সাধনা করে যাচ্ছেন তারা। মিতু যেদিন মারা যায় সেদিন তারা মিতুর লাশ বাদ দিয়ে আমাদের আলমারি থেকে আমাদের সব কাপড়-চোপড়, গয়না-গাটি আর জমানো কিছু টাকাপয়সা ব্যাগে ভরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসাতেই ব্যস্ত ছিল!
নিহত আকরামের বোন রিনি অভিযোগ করেছেন যে আমার প্রভাবে পুলিশ আকরাম হত্যার অভিযোগ থেকে আমার নাম বাদ দিয়েছিল। অথচ তিনি তখন আমার নামে কোনো অভিযোগই করেননি। রিনি তখন আদালতে অভিযোগ করেছিলেন যে আকরামের স্ত্রী তার ফুফাতো ভাই মুনের সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্কের জের ধরে আকরামকে খুন করে। ওই অভিযোগে আকরামের স্ত্রী, তার কথিত প্রেমিক মুন এবং আকরামের শ্বশুর-শ্বাশুড়ির নাম উল্লেখ করা হয়। তাছাড়া ঘটনার সময় আমি দেশেও ছিলাম না। যখনই আমি শ্বশুর-শ্বাশুড়ির অমতে বাচ্চাদের নিয়ে আলাদা বাসায় আমার মা-বাবাকে নিয়ে থাকা শুরু করলাম, তখনই আমার শ্বশুর আমার পরকীয়ার খোঁজ পেলেন, ঠিক তখনই আমার শ্বাশুড়ি মিতুর সঙ্গে আমার খারাপ সম্পর্কের কথা জানতে পারলেন, আর তখনই আকরামের বোন জানতে পারলেন তার ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে আমার পরকীয়া ছিল। তখনই তারা জানলেন চিত্রনাট্যের নাট্যকার ছিলাম আমি! এর মধ্যেই যে যা ইচ্ছে বলছে, ছাপছে। আমার ছেলেটা যখন এসব সংবাদ পড়ে ও দেখে তখন তার মানসিক অবস্থাটা কী দাঁড়ায়? কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র কারও ব্যক্তিস্বার্থে করা মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে যারা কথা বলছেন, তারা আমার জায়গায় নিজেকে একবার রাখুন, নিজের সন্তানটিকে আমার ছেলের জায়গায় ভাবুন। তারপর কলম হাতে নিন, সংবাদ বাণিজ্য করুন।
আজ আমার ছেলের জন্মদিন, মাকে ছাড়া প্রথম জন্মদিন তার। কী ভাবছে সে মনে মনে? কতটা কষ্ট পাচ্ছে সে? এসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায় কার? কথাগুলো একান্তই পারিবারিক। মেয়ে হারিয়ে মা-বাবার কষ্ট প্রকাশের একটা মাধ্যম হয়তো এসব ভিত্তিহীন অসংলগ্ন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কথাবার্তা, তাই আমি প্রত্যুত্তরে এতটুকু শব্দ করতেও নারাজ। কিন্তু এখন কথাগুলো পরিবারের সীমা পেরিয়ে লোকের ঘরে ঘরে বিনোদনের উৎস হিসেবে স্থান পেয়েছে। তাই আজ কিছু বলতে হলো। এত স্বল্প পরিসরে সবটুকু বলে শেষ করা সম্ভব নয়। যদি সব বলতে বসি তবে হয়তো একটা বই-ই হয়ে যেত’। সম্পাদনা: এনামুল হক