তিন বছরে দেড় শতাধিক বিস্ফোরণ মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার কমছে না
বিপ্লব বিশ্বাস ও ইসমাঈল হুসাইন ইমু: মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারের ব্যবহার চলছেই। ফলে সিএনজিচালিত যানবাহনের যান্ত্রিক ও ব্যবহৃত গ্যাসের সিলিন্ডারে ত্রুটির কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা। পাশাপাশি বাসা-বাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারের পুন:পরীক্ষা না হওয়ায় দুর্ঘটনা বাড়ছে।
নিয়ম রয়েছে পাঁচ বছর পর পর সিএনজিচালিত যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারের ফিটনেস পরীক্ষার। সেই সঙ্গে ফিটনেসবিহীন পরিবহন চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশনাও আছে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। গত ৩ বছরে দেশে সিএনজিচালিত যানবাহনে দেড় শতাধিক সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বিস্ফোরক অধিদফতর, আরপিজিসিএল ও হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে সোয়া দুই লাখ সিএনজিচালিত যানবাহন রয়েছে। সিএনজি নিরাপত্তার আন্তর্জাতিক মান নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডার পাঁচ বছর পর পর পরীক্ষার বিধান রয়েছে। কিন্তু মাত্র ২০ শতাংশ যানবাহনে সিলিন্ডারের পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিস্ফোরক অধিদফতরও বলছে গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ভয়াবহ পরিবহন দুর্ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী গত বছরের জানুয়ারি পযর্ন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৯১ হাজার ২১৯টি। এসবের মধ্যে ঠিক কী পরিমাণ যানবাহন সিএনজিচালিত তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই বিআরটিএ’র কাছে। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, গেল সপ্তাহে দেশের সড়কে ৭২ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে শুধু নরসিংদী ও ফরিদপুরেই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৪ জন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে ফরিদপুরের নগরকান্দায় গ্যাস সিলিন্ডারবাহী কাভার্ডভ্যানের সঙ্গে যাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষের পর আগুন ধরে যাওয়ায় ১৩ জন দগ্ধ হয়ে মারা যান। ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর সাভারের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোড়পুল নামকস্থানে তিতাস পরিবহনের একটি চলন্ত বাসের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ হন ১০ জন। ২০১৬ সালের ২০ আগস্ট বগুড়ায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হলেও বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) ডিপো। দুর্ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও ২২টি গ্যাস সিলিন্ডারে একসঙ্গে আগুন লেগে যায়। আর আগুন লাগার আগে চার থেকে পাঁচটি সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়। পদ্মা ওয়েল কোম্পানির তিনটি ট্রাক বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে এনএনবি পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে অন্তত ২০ জন আহত হন। ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ রাজধানীর সায়েন্সল্যাব সড়কে একটি মাইক্রোবাসে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিস ওই সময় জানায়, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মাইক্রোবাসটিতে আগুন ধরে যায়। সর্বশেষ ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মহাখালীতে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে হঠাৎ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট বাসের আগুন নিভিয়ে ফেলে। পরে ফায়ার সার্ভিসের সদর দফতর জানায়, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত।
এ বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি আতিকুল ইসলাম বলেন, তিন বছরে যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দেড় শতাধিক ঘটনা ঘটেছে। জনসাধারণের সচেতনার পাশাপাশি প্রয়োজন সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শক্ত পদক্ষেপ।
এদিকে বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে এবং বিভিন্ন যানবাহনে যেসব গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে তার বেশিরভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ এসব সিলিন্ডার যে কোনো সময় বিস্ফোরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সিলিন্ডারের দশ থেকে ১৫ বছর নির্দিষ্ট সময় মেয়াদ থাকলেও সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছার অভাবে সেগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে না।
বিস্ফোরক অধিদফতরের তথ্য মতে, বাজারে যেসব সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে তার ৮০ শতাংশ বেসরকারি কোম্পানিগুলোর। বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। তার মধ্যে বিপিসির সিলিন্ডার ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র ২০ শতাংশ।
জানা গেছে, গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে শেখদী স্কুল রোড সংলগ্ন বটতলায় একটি বেলুন তৈরির কারখানায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আনিস (৪০) ও অলিউল্লাহ (২০) নামের দুজন নিহত হন। এ দুর্ঘটনায় আহত হন আরও দুজন। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এছাড়া গত শনিবার ইসলাম বাগে প্লাস্টিক কারখানায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একই পরিবারের তিনজন নিহতের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় আহত দুজনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গত ১৫ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মীরহাজীরবাগ এলাকায় গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ওয়ালিউল্লাহ নামের একজন নিহত হন।
বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক সামসুল আলম বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে জেনেও নিয়মিত পরীক্ষা করা হচ্ছে না। প্রাইভেটকারের কিছু সিলিন্ডারের ফিটনেট রিপোর্ট আসে। তবে বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান বা অন্যান্য যানবাহনের কোনো তথ্যই অধিদফতরের কাছে নেই। আইন না থাকায় মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না বলে জানান তিনি। সম্পাদনা: এনামুল হক