পরিবহন শ্রমিকদের নৈরাজ্য ও সড়ক দুর্ঘটনা
মিল্টন বিশ্বাস
লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ফেব্রুয়ারির (২০১৭) শেষদিন থেকে হঠাৎ ধর্মঘটের ডাক দেওয়ার কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে সারাদেশের মানুষ। আর ভোগান্তির মাঝেই পরিবহন শ্রমিকরা তাদের ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। উল্লেখ্য, মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় পরিচালক তারেক মাসুদ ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর নিহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় জামির হোসেন নামের এক পরিবহন শ্রমিককে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন আদালত। ওই রায়ের পর খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় দুইদিন পরিবহন ধর্মঘট চলে এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনের আশ্বাসে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হলেও পরে শ্রমিক নেতারা কর্মসূচি বহাল রাখার কথা বলে। এরই মধ্যে ঢাকার সাভারে ট্রাকচাপায় এক নারীকে হত্যার দায়ে ওই তারিখেই (২৭) ট্রাকচালক মীর হোসেনের ফাঁসির রায় হয়। ফলে ওই রাতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির কর্মসূচি ঘোষণা দেয়। ২৮ তারিখ বিকেলে গাবতলীতে এক সমাবেশে বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের সভাপতি বলেছে, ‘আমাদের দাবি-দাওয়া সম্পূর্ণ মেনে নিলে শ্রমিকরা গাড়ি চালাবে। দাবি না মানলে কর্মসূচি চলবে। আইন বাতিল ও দ-িত চালকদের মুক্তি না দিলে গাড়ি চলবে না।’ পরিবহন শ্রমিকদের সমর্থন জানিয়েছেন নৌ পরিবহনমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, দ- মাথায় নিয়ে ড্রাইভাররা গাড়ি চালাতে পারবে না। অর্থাৎ বর্তমান সরকারের মন্ত্রী এবং সরকার সমর্থিত শ্রমিক নেতাদের কট্টর অবস্থানের কারণে জনগণের দুর্ভোগ চরম অবস্থায় উপনীত হয়েছে। সরকারের ভিতরে জনস্বার্থ পরিপন্থী নেতাকর্মীদের তৎপরতা সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে।
২. বহুদিন থেকে আমাদের দেশের পরিবহনে নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি প্রকাশ্যে চলে আসছে। এদেশের শ্রমিকরা যাত্রীসেবা না দিয়ে হয়রানি করে কুৎসিত আনন্দ উপভোগ করে থাকে। অর্থাৎ যাত্রী হিসেবে আমাদের নৌ, সড়ক ও রেলপথের দুর্ভোগের কথা মনে থাকে সবসময়; প্রতিটা মুহূর্ত আনন্দ হরণের ভীতিবোধ তাড়িত করে। সেজন্য সড়ক কিংবা রেলযাত্রার আনন্দ ভ্রমণের কথা মনে আসে না মানুষের। বরং নিরাপত্তাহীনতার কথা বেশি করে স্মরণ হয়। একাকি যাত্রার ভীতি, সেটা কেবল দুর্ঘটনা নয় সেটা আষ্ঠেপৃষ্ঠে বন্দী থাকে বিচিত্র আতঙ্কে। দুর্ঘটনা তা রেল কিংবা বাসের সংঘর্ষ নয় তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে অপরাধীদের বিভিন্ন তৎপরতার সঙ্গে। রেলপথে ভ্রমণে ছিনতাই, অপহরণ অথবা ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলার ঘটনা অহরহ ঘটছে। নৈশকোচে ডাকাতি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ঢাকা শহরে অটোরিকশায় আরোহণের ভোগান্তির কথা কে না জানে। ড্রাইভার কর্তৃক অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অপতৎপরতা কবে বন্ধ হবে? তাছাড়া রাজধানীর বাস-ড্রাইভারদের বেপরোয়া আচরণ আর শহরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা গাড়ির বহর দেখলে যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা বলে শেষ করা যায় না। অব্যবস্থাপনার কারণে আমরা নিত্যদিনের দুর্ভোগের শিকারে পরিণত হয়েছি। যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রীর নানা তৎপরতা, আর নানান ব্যবস্থা গ্রহণের পরও দুর্ভোগ কমেনি। বরং দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকা থেকে পাবনাগামী একটি বাসের সঙ্গে সিরাজগঞ্জে বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫ জন নিহত হন। তার ভিতর আমার আপন মামাতো ভাই লিটন চ্যাটার্জি ছিলেন। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া বাস দেখে বোঝা গেল কি ভয়ঙ্কর ছিল সেই দুর্ঘটনা। ওই দুর্ঘটনা ড্রাইভারদের ভুলের কারণে মর্মান্তিক হয়ে ওঠে। পরিবারের একমাত্র সন্তান স্ত্রী-সন্তানদের কাছ থেকে চিরবিদায় নেন। এ রকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় গত বছরগুলোর। যেমনÑ নাটোরের বড়াইগ্রামে নাটোর-ঢাকা মহাসড়কে দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হন ৩৪ যাত্রী। শোকজ্ঞাপন থেকে শুরু করে মিডিয়াতে ব্যাপক মতামত উপস্থাপিত হয় বিষয়টি নিয়ে। দুর্ঘটনার জন্য অবশ্যই কোনো মন্ত্রী কিংবা সচিব দায়ী নন। কিন্তু দায়ী যারা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় কি? হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে সড়ক হত্যায় অভিযুক্তকে জেলহাজতে পাঠান হয়। আবারও ঘটে নতুন ধরনের দুর্ঘটনা। ড্রাইভার দীর্ঘ পথ ট্রাক চালানোর পর ঘুমিয়ে পড়ে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে আতঙ্কিত যানটি ঢুকিয়ে মানুষকে চাপা দিয়ে মারে। মহাসড়ক দিয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়নায় ওভারটেক করতে গিয়ে সামনের গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে মৃত্যু ঘটে অনেকের। কেবল মৃত্যু নয় পঙ্গু হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের যে ব্যাপক ক্ষতি করা হয় তা থেকে রক্ষা পাবার কথা বারবার ভাবা হলেও কোনো উদ্যোগই কার্যকর হচ্ছে না। একই পরিবারের ৬ ভাইয়ের মৃত্যু ঘটে নাটোরের বড়াইগ্রামের দুর্ঘটনায়। পরিবারটির স্বান্ত¡নার জায়গা রইল কোথায়? দুর্ঘটনার সময় স্থানীয় মানুষকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলেও ওই একই সড়ক দিয়ে অন্যান্য বাসের চলাচলের তাড়নায় কোনো দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে দেখা যায় না। এজন্য দেখা যায়, সংঘর্ষের পর যাত্রীরা যখন কেউ লাশ, কেউ বা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন তখন ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী একটি কোচ দ্রুতগতিতে চলে যায় তাদের ওপর দিয়েই। এতে মহাসড়কে থেঁতলে যায় কয়েকজনের লাশ। যারা স্বজন হারালেন, তাদের সমবেদনা জানানোর ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
পরিবহন নৈরাজ্য এবং দুর্ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে একেকটি দুর্ঘটনার বীভৎস চিত্র দেখে গা শিউরে ওঠে। পথে বের হলে নিরাপদে বাড়ি ফেরা যাবে কি না, এর ভরসা নেই। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে হাইওয়ে ও জেলা সড়কগুলোয়। বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের (এআরসি) গবেষণা অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রতিবছর গড়ে ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু এবং আহত হয় ৩৫ হাজার। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মৃত্যুর হার ৮৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ছাড়াও আহত ও স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ববরণের হারও কম নয়। এ সমস্যা একটি সোশ্যাল বা সামাজিক ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়েছে। মানুষকে প্রয়োজনে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতেই হয়, যানবাহনে চড়তেই হয়। কিন্তু প্রতিনিয়ত যদি লাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে শঙ্কিত থাকতে হয়, তাহলে এটি কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি হতে পারে না।’ সড়ক দুর্ঘটনা এখন কেবল সামাজিক ট্র্যাজেডি নয় এর পেছনে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় রয়েছে। উপরন্তু বিচারহীন, প্রতিকারহীন ঘটনা ঘটতে থাকলে মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নেবে এটাই স্বাভাবিক। এজন্য দুর্ঘটনার পর ড্রাইভার পালিয়ে যায়। কিংবা অনেক ড্রাইভারের নিজের প্রাণও বিনষ্ট হয়। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত আইনটি দুর্বল হওয়ায় অভিযুক্তরা সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে।
বছর ঘুরে মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার দিনটি ঘটা করে পালন হবে এবং সভা করে দুর্ঘটনা রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হবে। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ও সিগন্যালিং ব্যবস্থা, চালকের অদক্ষতা-দায়িত্বহীনতা, ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ না হওয়াÑ এসবের বলি যে সাধারণ মানুষ তার কি কিছু উন্নতি হবে? নিরাপদ সড়কের প্রধান শর্ত সচেতনতা। কিন্তু পথচারী সচেতন হলেও উল্টোপথে আসা, নিয়ম না মেনে চলা গাড়ি যে আমাদের ঘাড়ে এসে পড়বে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?
ইতোমধ্যে যানবাহনের চলাচল পর্যবেক্ষণের জন্য ঢাকার ১৪টি প্রবেশমুখে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে মহাসড়কে সিসিটিভিসহ গতি পরিমাপের যন্ত্র বসানো দরকার। মহাসড়কে পুলিশি টহল বাড়াতে হবে। কারণ বর্তমানে দুই হাজার ১৯০ জন হাইওয়ে পুলিশ সদস্য এক হাজার ৯০০ কিলোমিটার মহাসড়ক পাহারা দেয়। দুর্ঘটনা রোধে আরও ভূমিকা রাখতে হলে লোকবল ও আনুষঙ্গিক সুবিধা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ দুর্ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বাকিদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়া গেলে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত ব্যক্তিদের চিকিৎসা জটিল- এজন্য দ্রুত চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। সড়কের পাশে গড়ে তোলা দরকার ট্রমা সেন্টার। এক্ষেত্রে দেশের বিত্তশালীরা এগিয়ে আসতে পারেন। প্রতিটি জেলার ধনবান ব্যক্তিরা মহাসড়কের কাছে ট্রমা সেন্টারসহ সাধারণ হাসপাতাল গড়ে দিলে দ্রুত চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হবে। তবে আমরা সেই চিন্তার আগে দুর্ঘটনার হুল উৎপাটন করতে চাই সমূলে।
৩. পরিবহন শ্রমিক নেতাদের মনে রাখতে হবে, সকল সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ৯০ শতাংশ ড্রাইভারই দায়ী থাকে। তাদের আচরণ পাল্টাতে হবে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নজরদারি বাড়াতে হবে। আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চাইলে সরকারকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সড়ক নিরাপত্তা দশক ঘোষণা করেছে। প্রতিটি সদস্য দেশকে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে এমন কোনো পরিকল্পনা তৈরির কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বলে এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি। এছাড়া গণমাধ্যমে একটা নির্দিষ্ট সময়ে লাগাতার সচেতনতামূলক কর্মসূচি প্রচার করতে হবে। আর চালকদের জন্য প্রতিটি জেলার পরিবহন কমিটির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেওয়া দরকার। তবেই দুর্ঘটনার হুল সমূলে উৎপাটন সম্ভব।
সম্পাদনা: আশিক রহমান