বৈপরীত্যের রাজনীতি এবং তার কল্পগল্প
কাকন রেজা
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বাংলাদেশে একদিনে দুটো ‘বনধ’ ডাকা হলো। একটির নাম ‘হরতাল’, অন্যটির ‘পরিবহন ধর্মঘট’। প্রথমোক্তটি ডাকার কারণ হলো, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি। দ্বিতীয়টি তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের মৃত্যুর জন্য আদালতকর্তৃক স্বীকৃত এবং সাজাপ্রাপ্ত বাসচালকের দ-ের প্রতিবাদ। দুটো নিয়েই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক ক্যাচাল। আমাদের মতোন ছাপোষা আমজনতার রাজনীতি পোষায় না। রাজনীতিতে দুটি পক্ষ থেকে, যাদের কাজ পরস্পরের লেজে কামড়ানো। দাঁতের জোর না থাকায় আমাদের মতো ‘ম্যাঙ্গোপিপলে’র কামড়ানোর প্রক্রিয়ায় না জড়ানোই ভালো।
‘হরতাল’ নিয়ে আমাদের এক দায়িত্বশীল বললেন, ‘গ্যাসের দাম কম ছিল, তাই বাড়ানো হয়েছে’। কথা পরিষ্কার। এটা নিয়ে আবার কেন ‘হরতাল’ ডাকা! অথচ আরেকপক্ষ টিপ্পনি কাটতে বসে গেলেন। রাস্তায় কিছু করার মুরোদ নেই, তাই তারা বেছে নিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যকে। নানা কথা বলতে শুরু করলেন। বললেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি কীসের জন্য, আমাদের জন্যই তো। আমাদের ভালোর জন্য। মধ্যম আয়ের দেশের লোকের একটা ইজ্জত আছে না। আশেপাশের দেশের থেকে আমাদের দেশে গ্যাসের দাম কম থাকবে কেন! আমরা কী কম দামি গাড়ি ব্যবহার করি! আমাদের দেশের কী পরিমাণ আইফোন বিক্রি হয় জানেন? গ্যাসের দাম নিয়ে এসব হরতাল ফরতাল করে আমাদের আমার নিম্নআয়ের দেশ বানানোর ষড়যন্ত্র চলছে। দেখেন তো কথার কী ধরন!
সারাবিশ্বে যখন এক লিটার ‘মিনারেল ওয়াটারে’র চেয়ে এক লিটার পেট্রোলের দাম কমে গেল, তখনো আমরা সর্বোচ্চ দরে পেট্রোল বিকোলাম, এখনো বিকোচ্ছে, এটা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ হয়েছে? হয়নি। কেন হয়নি? এটা তো হরলিকসের বিজ্ঞাপন নয় যে, বাচ্চারা বলবে, ‘আমি তো এমনি এমনি খাই’। আরে এমনি এমনি কিছুই হয় না, এর পেছনে ‘তেল-পানি’ খরচ করতে হয়। এত দামেও তেল কিনে গাড়ি চালাচ্ছে গাড়ির মালিকেরা, বেশি ভাড়া দিয়ে গাড়ি চড়ছে এবং সড়ক দুর্ঘটনায় মরছেও যাত্রীরা। কোথাও কোনো প্রতিবাদ নেই। অথচ তারেক-মুনীর মরল তা নিয়ে কাগজওয়ালাদের মাথা খারাপ হয়ে গেল, একেবারে বেলগাছের কাঁটাওয়ালা সংবাদ ও লেখা বের করতে শুরু করল। এদিকে আবার ড্রাইভারের শাস্তি দিল আদালত; শুরু হয়ে গেল ‘চাক্কাবনধ’। কোনটা ছেড়ে কোনটা সামলাই! আরে ভাই এসব কারণেই তো পেট্রোলের দাম কমানো সম্ভব হয় না, সব সামলাতে খরচাপাতি আছে না! কন তো দেখি, বিপক্ষের এমন ত্যাড়াব্যাকা প্যাচাল শুনলে কার না মাথা গরম হয়।
যাই হোক, এসব পক্ষ-বিপক্ষের রাজনৈতিক প্যাচাল থাক। এগুলো সবই রাজনীতিকে ঘিরে কল্পিত এবং ‘বাকোয়াজ’ রাজনৈতিক কথামালা, শব্দবাজি। এসব রাজনৈতিক ক্যাচালের মধ্যে আমাদের মতোন ‘ম্যাঙ্গো পিপল’ মানে আমজনতার থাকতে নেই। তার থেকে একটি ‘চিত্রদৃশ্য’ নিয়ে কথা বলি। হরতালের দিন সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিউজ ফিডে যে ছবির দৃশ্য দৃষ্টি কেড়েছে সবার। ছবিটিতে হরতাল সমর্থক এক তরুণীকে পুলিশ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে চাইছে অন্যদিকে একটি কুকুর তরুণীর কাপড় কামড়ে ধরে নিতে বাধা দিচ্ছে। দুপক্ষের এমন টানাটানির দৃশ্য রীতিমতো ভাইরাল হবার পথে। জানি না কুকুরের বিরুদ্ধে ‘বাধা দেওয়া বিষয়ক’ কোনো মামলা চলে কি না! মানুষ হলে অন্য কথা ছিল।
দুপক্ষের টানটানির ছবিটিকে ঘিরে দুভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হতে পারে এবং হচ্ছে। প্রথমত, হরতালবিরোধী নেতাশ্রেণির একজন বললেন, ‘যারা হরতাল ডেকেছে তাদের লজ্জা নেই। হরতালে গাড়িঘোড়া সব চলেছে, জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক।’ কথা মিথ্যা নয়, তাদের কথার চাক্ষুস প্রমাণ হলো, সেই ছবিটি। মানুষ যদি হরতালের পক্ষে থাকত তাহলে হরতাল সমর্থক সেই তরুণীকে বাঁচাতে কুকুর টানাটানি করত না, মানুষই করত। নাকি? অন্য ব্যাখ্যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিটিকে নিয়ে ‘নেতা’ বা ‘কেতা’ নন এমন এক আমজনতার দাবি, ‘ন্যায়-অন্যায় কুকুরের মতো পশুও বোঝে!’ পশু তো বোঝে কিন্তু মানুষ?
আসলে মানুষ কী বোঝে, এ নিয়ে আমিও সংশয়ে। গত বছর ইরাকে যুদ্ধবিগ্রহে যতলোক মারা গেছে তার থেকে নাকি বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বেশি লোক মারা গিয়েছে পরিসংখ্যান নাকি তাই বলে! এমনি বললেন একজন। অবশ্য শোনা কথায় বিশ্বাস করতে নেই। কোনো একটি কাগজে দুর্ঘটনা বিষয়ক খবরের শিরোনাম ছিল অনেকটা এ রকম, ‘সড়কে লাশের মিছিল’। প্রতিনিয়ত এমন ‘মিছিলে’ আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমরা অবশ্য সবকিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে যাই। অভ্যস্ত হয়ে যাবার মতোন গুণ আমাদের মতো বোধহয় সারা পৃথিবীর অন্যকোনো ‘হোমো সেপিয়েন্স’দের মধ্যে নেই।
‘প্রতিদিন কাগজে দেখছি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর। একই পরিবারের ৫ জন, পিতাপুত্র একসঙ্গে, জায়াজননী গলা জড়িয়ে, এসব খবরে আমাদের কানমাথা নড়ে না, কিন্তু নড়ে তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর মরলে!’ এটা আমার কথা নয়, দুর্ঘটনা কবলিত এক সন্তানের বিপন্ন পিতার প্রশ্ন। এমন প্রশ্নের কী উত্তর, আমি জানি না! তবে এটুকু বুঝি, আমাদের ব্যক্তিস্বার্থের কাছে সামষ্টিক স্বার্থ উপেক্ষিত। আমাদের যাতনার চেতনা উত্থিত হয় শুধু নিজ স্বার্থে কিংবা স্বীয় গোষ্ঠীর স্বার্থ আঘাতপ্রাপ্ত হলে। আমরা যদি ভাবতাম দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া প্রতিটি মানুষই তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীর তাহলে হয়তো ‘পরিবহন ধর্মঘট’ এর মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। প্রয়োজন হতো না আদালতের শাস্তির।
ভাবনা বিষয়ক কথায় মনে পড়ে গেল একজন সেলিব্রেটির ফেসবুক স্ট্যাটাসের কথা। তিনি বললেন, ‘কতজন মানুষ গ্যাস সংযোগ পেয়েছে? দেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্যাসের সুবিধা পায়নি। গ্যাসের দাম বাড়ানো নিয়ে কিছু মানুষের সঙ্গ না দিয়ে দেশের বেশির ভাগ মানুষের কথা ভাবুন’ এমন ধরনের কথা। ভালো খুবই ভালো, আপনার আমজনতার জন্য দরদের বিষয়টি খুবই ভালো! কিন্তু ভাইজান, গ্যাসের প্রশ্নে আপনার এ অবস্থান কী তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরের পক্ষে নেওয়া অবস্থানের সঙ্গে মেলে! সড়ক দুর্ঘটনায় মাসুদ, মুনীরের আগে কি কোনো মানুষ মারা যায়নি? গেছে তো, তাহলে! তখন তো আপনাকে, আপনাদের এত উচ্চকণ্ঠ হতে দেখিনি, কেন দেখিনি? গ্যাস নিয়ে দাবি করা কে বলবেন গুটি কয়েকের দাবি, অথচ তারেক, মুনীর মরলে লাফ দিয়ে উঠবেন! ‘সড়কে লাশের মিছিল’ কী আগে আপনাদের চোখে পড়েনি! শতশত মানুষের মৃত্যু কি মৃত্যু নয়!
এমন সব অদ্ভুত বৈপরীত্যের জন্যই আজ আমাদের পদে পদে বিপদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কথা ও কাজের মিল না থাকার জন্য, আমাদের সমাজের বিভিন্ন জায়গায় আজ এত অমিল, এত গ-গোল। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে অন্ধত্ব, পক্ষপাতিত্ব আমাদের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে দিচ্ছে না। আমরা যখন স্বাধীন হই তখন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া আমাদের চেয়ে এগিয়ে ছিল না। অথচ আজ তারা আমাদের উদাহরণ! আমাদের এই ক্রমাগত পশ্চাৎপদতার জন্য, উল্টোমুখী পদযাত্রার জন্য আমরা কাদের দায়ী করব?
ফুটনোট: কিছু মানুষের এমন বৈপরীত্য দেখে মাঝে মধ্যে মনে হয় ডারউইন সাহেবের বিবর্তনবাদ, আমার ভাষায় ‘বান্দরতত্ত্ব’ একেবারে মিথ্যা নয়। বিবর্তিত হয়ে কিছু কিছু মানুষ হয়েছে, আর ‘যেইগুলান হইতে পারে নাই, সেইগুলান বান্দর রইয়া গ্যাছে’। কী বলেন আপনারা?
সম্পাদনা: আশিক রহমান