সুনানে নাসায়ী : হাদিসের জগতে নন্দিত নাম
মুফতী আজিজুল্লাহ কাসেমী
আস্ সুনান লিন্নাসায়ী। মূলনাম ‘আল মুজতাবা’ (বা নির্বাচিত হাদিস সংকলন)। ইমাম নাসায়ী তার পূর্বলিখিত বৃহত গ্রন্থ ‘সুনানে কুবরা’ থেকে নির্বাচন করে শুধুমাত্র সহীহ এবং কিছু হাসান হাদিস নিয়ে সংকলন করেছেন এ গ্রন্থটি। উক্ত গ্রন্থে দুর্বল সূত্রের বর্ণনা অন্যান্য সুনানের তুলনায় কম বিধায় সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের পরেই বিশুদ্ধতার বিচারে এর অবস্থান। অর্থাৎ পৃথিবীর বুকে কুরআনের পর বিশুদ্ধতম তৃতীয় গ্রন্থ হলো ‘সুনানে নাসায়ী’। -আন্নুকাত ১/৪৮৪।
অধ্যায় বিন্যাস বা সূচি নির্মাণে ‘ফিকহী তারতীব’ বা মানুষের ব্যবহারিক জিবনের বিধি-বিধানকে প্রাধান্য দেয়ায় গ্রন্থটিকে হাদিস গ্রন্থসমূহের ‘সুনান’ প্রকরণের অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়। সেজন্যেই মুমিন জীবনের সর্বাধিক অনুশীলিত ‘নামায’ ও তদপূর্ববর্তী পাক-পবিত্রতার বর্ণনা দিয়ে গ্রন্থটির সূচনা করা হয়েছে। হাদিস চয়নের ক্ষেত্রে ইমাম নাসায়ী কিছুটা শক্ত নীতিমালা অনুসরণ করায় দুর্বল সূত্রের বর্ণনা তাতে তেমন স্থান করতে পারেনি। তবুও বিজ্ঞজনদের মতে দুর্বল বর্ণনার সংখ্যা তিনশ’ পার হবে; যার অনেকগুলো নির্ধারণ করে দিয়েছেন ইমাম নিজেই। পরবর্তী মুহাদ্দিসীনের বদান্যাতায় বাকিগুলোও এখন স্পষ্ট। এ গ্রন্থে তিনি আরো যা কিছু করেছেন: এক, তিনি সকল অধ্যায়ের সূচনাতে সহীহ হাদিস এনেছেন। বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে, যেমন কোন দুর্বল সূত্রের বিবরণে বর্ণিত সহীহ হাদিসের তুলনায় প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অংশ থাকলে তিনি দুর্বল বর্ণনাটি উল্লেখ করে ক্ষেত্রবিশেষে দুর্বলতার কারণও স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
দুই, স্থান উপযোগিতার বিচারে একটি হাদিসকে অথবা হাদিসের খণ্ডিত অংশকে ইমাম বুখারীর মত একাধিক জায়গায় এনেছেন। শুধুমাত্র ‘নিয়্যাতের হাদিস’টিকে তার এ গ্রন্থে ষোল জায়গায় পুনরুক্ত করেছেন।
তিন, হাদিসের একাধিক সূত্রকে পরিপূর্ণভাবে উল্লেখ করেছেন। বিপরীতমুখী বর্ণনা থাকলে সেটাকেও কখনো কখনো উল্লেখ করেছেন। অনেকের মতে তিনি এমনটি সেখানেই করেছেন, যেখানে উভয় রকম বিধান মানাকে তিনি বৈধ মনে করেন। যেমন তিনি নামাযে ফাতেহা পাঠের পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ নিম্ন আওয়ায ও উচ্চস্বরে পাঠের উভয়রকম হাদিস একত্রিত করেছেন। তাদের মতে উভয়টার যেকোনটির উপর আমল করাকে বৈধ মনে করেন বলে তিনি এমনটি করেছেন। তাছাড়া তিনি সাধ্যের আওতায় কোনও মাযহাবের গুরুত্বপূর্ণ ফকীহ থেকে নেয়া হাদিস এ গ্রন্থে আনেননি। তিনি এভাবে তিনি প্রায় ৬০০০ হাদিসের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন গ্রন্থটিতে। যার অনেক হাদিস বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে। অনেকগুলো রয়েছে এমন, যা তাদের শর্তমানে উন্নীত। বাকিগুলোকে সনদ মুত্তাসেল (তথা রাসুল সা. পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতাহীন ধারাসূত্রে বর্ণিত) হওয়া এবং সর্বসম্মত মাতরূক (বা অগ্রহনযোগ্য) না হওয়ার শর্তে তার গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন।
খুরাসানের ‘নাসা’ অঞ্চলে গ্রন্থরচয়িতার জন্ম বিধায় তাকে ‘নাসায়ী’ ও তার গ্রন্থকে ‘সুনানে নাসায়ী’ নামে অভিহিত করা হয়। তার পূর্ণ নাম আহমাদ বিন আলী বিন শুয়াইব বিন আলী বিন সিনান। জন্ম ২১৫ হিজরী। ৩০৩ হিজরীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বহু বিষয়ের পারদর্শী এ মহান ব্যক্তি শুধুমাত্র হাদিসের অন্বেষণে বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। কুতাইবা ইবনে সাঈদ, ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ ও ইমাম আবু দাউদের মত অন্যান্য শ্রেষ্ঠ হাদিসবেত্তাগণ ছিলেন তার উস্তাদ। শিষ্যদের দীর্ঘ তালিকায় রয়েছেন ইমাম তাবরানী, আবু আলী নায়সাবুরী ও ইমাম ত্বহাবীর মত ব্যক্তিগণ, যারা আপন সময়ের একেকজন স্বর্ণমানব। অসাধারণ দৈহিক শক্তির অধিকারী সুশ্রী-মানব ইমাম নাসায়ী ব্যক্তিজীবনে ছিলেন একজন খোদাভীরু, ইবাদতগুজার, নম্র-ভদ্র ও মার্জিত রুচির অধিকারী। মূল্যবান পোশাক পরতেন, উন্নত খাবার খেতেন। হাফিজুুল হাদীস ইমাম যাহাবী বলেন, ‘ইমাম নাসায়ী ছিলেন ইলমে হাদীসের সুগভীর জ্ঞান, নির্ভরযোগ্য সুক্ষ্মদৃষ্টি ও রাবীদের উত্তম সমালোচনার ক্ষেত্রে একজন অনন্য ব্যক্তি। ’ সিয়ার, ১৪/১১৭।
এভাবে বহু মুহাদ্দিসীন তাকে ‘হাদীসের ইমাম’ অভিষিক্ত করে ইলমে হাদীসে তার শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্যের ব্যাপারে সাক্ষি দিয়েছেন। বিদায়া নিহায়া ১১/১৩৩।
সুনানে নাসায়ীর পাশাপাশি ফাযায়েলুল কুরআন, আত ত্ববাক্বাত, ‘আমালুল য়াওমি ওল্লাইলাহ সহ তার রয়েছে অনেক অনন্য রচনা, যা আজো পৃথিবীতে আলো ছড়ায়। হযরত আলী রা. এর মর্যাদা সম্বলিত একটি সংকলন তৈরি করেছিলেন তিনি। এ কারণে কিছু লোক তাকে শিয়া মনে করে আক্রমন করেছিল। এ আক্রমনের সূত্র ধরেই তার ইন্তেকাল হয়। এবং মক্কা মুকাররমায় তাকে দাফন করা হয়। আল্লাহ তায়ালা তার কবরকে শান্তিময় করুন, জান্নাতে সমুচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করুন। আমীন! তথ্যসূত্র: তাহযীবুল কামাল, আল আ’লাম, তাযকিরাতুল হুফফাজ, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, আন নুকাত লিবনি হাজার।