আপনার জীবন কি জটিল ও ভারবহ হয়ে উঠছে?
ডা. মো. তাজুল ইসলাম
লেখক: অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
আপনার জীবন কি জটিল, কঠিন, ভারবহ হয়ে উঠছে? জীবনকে সহজ- স্বাচ্ছন্দ্য রাখতে যা করবেনÑ চীনের মহান দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক নেতা কনফুসিয়াস বলেছিলেন ‘জীবন সত্যিই সহজ, সরল কিন্তু আমরা একে জটিল করতে গো ধরি। আমরা অনেকেই জীবনের মূল উদ্দেশ্য ভুলে গেছি। উল্টো একে ঢেকে দিচ্ছি নানা কাজ, টুকিটাকি মামুলি, ক্লান্তিকর কাজ এবং দায়িত্ব প্রভৃতির রকমারি সমাবেশে দিয়ে। পরে অভিযোগ করছিÑ জীবন এত কঠিন কেন? জীবন এত পীড়াদায়ক, জটিল কেন? আপনি জীবনকে সহজ করতে পারেন, আবার জটিলও করতে পারেন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব আপনার।
এক. আপনি কি প্রতিদিন দৌড়ের উপর থাকেন? জীবনের সবচেয়ে বড় স্ট্রেস হচ্ছে বিরামহীন কাজের শিডিউল নিয়ে দৌড়ের উপর থাকা। মনে রাখবেন, আপনার আজকের জীবন কিন্তু আপনিই তৈরি করছেন। আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, কতটুকু সময় আপনি কিভাবে ব্যয় করবেন। (যদি তা পারছেন না মনে হয়, তাহলে আপনি নিজ জীবনের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছেন না বুঝতে হবে)। প্রকৃতির কোনোকিছুই অবিরাম দৌড়ের উপর থাকে না। তাহলে আমরা কেন? একটু ধীরে চলুন, গভীরভাবে শ্বাস নিন এবং নিরুদ্বেগ থাকুন। আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি শুধু কিছু রুটিন, কাট-খোট্টা কাজ করব ও তারপর মরে যাব, এত ছোট ও সীমিত উদ্দেশ্যে নয়। আমরা এখানে এসেছি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য, ভালোভাবে বাঁচার জন্য, নিজদের বিকশিত করার জন্য, মহৎ ও সৃজনশীল কিছু করার জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে অধিকতর বাসযোগ্য করার জন্য এবং অতি অবিশ্যি জীবনকে উপভোগ করার জন্য।
দুই. বর্তমানে জীবনযাপন না করে কোন সুদূরে বসবাস করছেন? আমাদের কি মনে আছে টলস্টয়ের সেই ‘থ্রি কোয়েশ্চেন’ গল্পের সারমর্ম? জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ সময় কোনটি? উত্তর হচ্ছেÑ ‘বর্তমান মুহূর্ত’ আগের মুহূর্ত অতীত, পরবর্তী মুহূর্ত ভবিষ্যৎ। কোনোটিই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই ভবিষ্যতের উপর নির্ভর করে বাঁচলে বর্তমান জীবন হবে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা পূর্ণ। তার বদলে সচেতনভাবে প্রতিদিনই নিজের ‘ভবিষ্যৎ’ তৈরি করুন এবং এ মুহূর্তে যে জীবনযাপন করছেন, তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকুন। বর্তমানকে উৎসবে রূপান্তর করুন (ইদুর দৌড়ে পরিশ্রান্ত না হয়ে)। এভাবে আপনি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয়টি উপভোগ করতে পারবেন। মনে রাখবেন বর্তমান হচ্ছে একমাত্র মুহূর্ত, যেটি আমাদের জন্য বাস্তব সত্য।
তিন. অন্যরা আপনাকে নিয়ে কি ভাবছে সে নিয়ে আপনি অধিক চিন্তিত? একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য নোট করে রাখুন। কিছু মানুষ আপনাকে সবসময় ভালোবাসবে, আপনি যে রকমই হোন না কেন। তেমনি কিছু লোক কখনোই আপনাকে পছন্দ করবে না, যত ভালো আপনি সাজুন না কেন’। সাইকিয়াট্রিতে ‘এট্রিবিউশন থিওরি’ বলে একটি তত্ত্ব আছে। আমরা নিজের মতো করে অন্যকে ‘ভালো বা মন্দ’ এ রকম লেবেল দিয়ে থাকি (সে ব্যক্তি প্রকৃত যে রকমই হোক না কেন)। তাই তিক্ত সত্য হচ্ছে, কোনো কারণ ছাড়াই কিছু লোক আপনাকে ‘অপছন্দ’ করবে। অন্যরা যাতে আপনাকে ভালো জানে, পছন্দ করে, সম্মান, শ্রদ্ধা করে এ জন্য তাদের কনভেন্স করার সার্বক্ষণিক চেষ্টা বা নিজের সবকিছু দিয়ে তাদেরকে ইম্প্রেস করার হীনমন্য চেষ্টা আপনাকে হতাশ করবে।
নিজের সততা, যোগ্যতা, সম্মান ও ভালোত্বের সার্টিফিকেট অন্যদের কাছ থেকে পেতে চাইবেন না। এ রকম সুযোগ তাদের দিলে, তাদের অনুমোদন, তাদের সমর্থনের উপর নির্ভর করলে, কপালে খারাপি আছে। তারা ইচ্ছে মতো তা দেবে, আপনি কি, সে হিসেবে কখনো নয় (ফেসবুকে লাইক কমেন্ট এর ধরন লক্ষ্য করেছেন? কতজন ভালো লেখাকে লাইক দেয়? তারা লাইক দেয় ‘সেলিব্রেটি বা ছেলেবিট্রি’ দেখে, তেলমর্দনের জন্য, গ্রুপে থাকার জন্য, নিজের লোক মনে করে ইত্যাদি। আপনাকে লাইক দিলে যদি আপনি জনপ্রিয় হয়ে যান, আলোচিত হয়ে যান, অন্যরা দেখে ফেলে সে ওমুককে লাইক দিয়েছে বা আপনাকে পাত্তা না দেওয়ার জেদ থেকেও অনেকে ভালো লেখায়ও লাইক দেবে না। ফেসবুকে লাইক কমেন্টের সাইকোলজি নিয়ে একদিন লেখার ইচ্ছে আছে)
এ রকম দৃষ্টিভঙ্গি শুধু আমজনতার নয়, বরং তথাকথিত শিক্ষিত, জ্ঞানী ব্যক্তিদের মধ্যে এ হীনমন্যতা আরও বেশি। তার মানে কারও কাছ থেকে মুফতে (বিনা পয়সায়) কিছু পাওয়ার আশা করবেন না। তাই নিজের সার্টিফিকেট এর সত্যায়ন (ভ্যালিডেশন) নিজে করবেন, তাহলে অন্যের সার্টিফিকেট ‘অনুমোদন’ নিয়ে জীবন চালানোর ‘গ্লানি’ থেকে মুক্তি পাবেন। (কিছুদিন আগে পুরনো ৪ বন্ধু ও ২ বন্ধুর স্ত্রী এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াতে গেলাম। কিছু লোক সবসময় ‘ভালো’ বন্ধু, কিছু সবসময় ‘ক্রিটিক্যাল’। এই তথ্য মনো সমস্যা বিষয়ক বই লেখার পর ভালো করে উপলব্ধি করেছি, তার আগে নয়। তাই কোনগুলো ‘কমফোর্ট’ জোন ও কোনগুলো ‘ইরিটেটিং’ জোন, তা বুঝতে শিখেছি এবং এসারটিভলি তা হ্যান্ডেল করার দক্ষতা অর্জিত হয়েছে)। অন্যকে হেয়, তুচ্ছ ও ব্যঙ্গ করা যাদের অভ্যাস তাদের কোনোভাবেই তা করার ন্যূনতম সুযোগ দেবেন না। প্রথমে তারা আপনার উচ্চ মাথা, দৃঢ়তা, প্রবল প্রতিরোধ দেখে আরও বৈরী হবে। কিন্তু আপনার দৃঢ়তা ও আত্মসম্মান বোধের কাছে একসময় পরাজিত হবেই। আর না হলে আপনার কিছু যায় আসে না। হয় তাদের আপনি যে রকম সেটিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিতে হবে, না হয় তাদের প্রত্যাখ্যানই হবে সমুচিত জবাব। পাওয়ার অব পজিটিভিটির কথা মনে রাখুন ‘যারা আপনাকে সম্মান করে না, তারা আপনার জীবন থেকে হারিয়ে গেলে বা তাড়িয়ে দিলে আপনার ক্ষতি নয়, বরং লাভ।’ এবং ‘বিষাক্ত ব্যক্তিরা (টক্সিক পিপল) জীবন থেকে বাদ পড়লে ভালোবাসার ব্যক্তিদের জন্য জায়গা তৈরি হবে’। তাই অন্যরা আপনাকে নিয়ে কি ভাবছে, কেমন ভাবছে এই হীনমন্য চিন্তা ঝেড়ে ফেলুন। বরং আপনি তাদের কি রকম জানছেন সেটিই মুখ্য। কমফোর্ট মনে হলে এগিয়ে যান, ইরিটেটিং হলে দূরে রাখুন।
চার. আপনি কি নেতিবাচক চিন্তায় বুদ থাকেন? ‘অতীতে বসবাস’ আমাদের জীবনকে দুঃখ ও যন্ত্রণায় ভরে তোলে, জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। জীবনে যত কষ্ট, ব্যর্থতা, বিড়ম্বনা, হতাশা, অপমান, গ্লানি রয়েছে সেগুলোর দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করে আমরা জীবনকে আরও দুঃখভারাক্রান্ত করে তুলি। যারা আপনাকে আহত করেছে তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। সকল তিক্ত ও কষ্টদায়ক স্মৃতিগুলো পেছনে ফেলে রাখুন এবং বর্তমানের জীবনকে অর্থময় করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করুন। আপনি অতীতকে পরিবর্তন করতে পারবেন না, কিন্তু আপনি আপনার চিন্তা ও কাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
পাঁচ. আপনি কি নিজের সঙ্গে সৎ? সুখি ও আদর্শ জীবন পেতে চাইলে নিজের ভিতরকার ‘দানব’গুলোর উপর নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে হবে। (কুরবানি ঈদের তাৎপর্য হচ্ছে, নিজের ভিতরের পশুত্বকে কুরবানি দেওয়া। আমরা বাস্তবে কি করছি?)। আমরা কতজন সততার সহিত নিজের ভিতরকার দানব সত্তার কথা স্বীকার করি ও সেটিকে দমনে আন্তরিক প্রচেষ্টা নিই? আপনাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তেমন কিছুকে যদি দীর্ঘদিন এড়িয়ে চলেন, তাহলে একসময় সেগুলো এমন শক্তিশালী হয়ে উঠবে যে, তখন আপনি পুরো বিপর্যস্ত হয়ে পরবেন। সেগুলো আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আপনি ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাবেন।
পুরনো ক্ষতকে খুচিয়ে লাভ নেই। তবে এগুলো এড়িয়ে গেলেও চলবে না। সে ক্ষত মোচনে যা করণীয় তা করতে হবে। প্রয়োজনে প্রফেশনাল কাউন্সিলিং/ সাইকোথেরাপি নিতে হবে। নিজের সঙ্গে সৎ থাকতে হবে। নিজকে ফাঁকি দেওয়া সবচেয়ে অন্যায্য, ক্ষতিকর কাজ। সততার সঙ্গে নিজের সব ক্ষত, বেদনাকে স্বীকার করে নিন। সেগুলো নিরাময়ে সচেষ্ট হোন। তা না হলে পুরনো ক্ষত গ্যাংরিন হয়ে সর্বনাশ আনতে পারে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান