এসব বোকা শ্রমিকদের কী হবে এখন!
প্রতীক ইজাজ
মঙ্গল ও বুধ ছিল দেশজুড়ে পরিবহন ধর্মঘট। কোনোকিছু না বলেই, কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই, সড়ক পথে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিলেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। কেউ-ই জানল না কিছু; না সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল, না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। হঠাৎ করেই সোমবার রাতে ঘোষণা এলো। মঙ্গলবার বন্ধ হয়ে গেল প্রথমে চুয়াডাঙ্গা ও পরে খুলনা অঞ্চলের ১০ জেলার পরিবহন। পরদিন গোটা দেশে। মালিক-শ্রমিকদের ঔদ্ধত্য, স্বেচ্ছচারিতা, স্পর্ধা হতবাক করল মানুষকে। স্পষ্ট হলো পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা। দৃশ্যমান নৈরাজ্য। জনগণকে জিম্মি করে, অবিবেচ্য দাবি আদায়ের নামে, নতুন বার্তা দিল মালিক-শ্রমিকরা। বুঝিয়ে দিল সরকার তো তথৈবচ; আদালতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনেও ভীত নয় এরা। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে এক বিকল্প শক্তি! সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছেÑ এত সাহস কোথায় পেলেন এসব মালিক-শ্রমিকরা? এটা কি মালিক-শ্রমিকদের একতা; নাকি শ্রমিকদের পুঁজি করে রাষ্ট্রে আধিপত্য বিস্তারে মালিকদের পুরনো কৌশল?
এটা কি শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ সংহতি, কষ্টার্জিত শ্রমের ফসল, শ্রমিক আন্দোলনের বিকাশ; নাকি বঞ্চিত অশিক্ষিত দরিদ্র শ্রমিকদের জিম্মি করে, মৃত্যু ও সমূহ বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে মালিক-শ্রমিক নেতাদের পুঁজি ও ক্ষমতা বৃদ্ধি? আমি জানি না এসব প্রশ্নের কি উত্তর দেবেন কায়ক্লেশে কষ্ট করে দিনাতিপাত করা পরিবহন শ্রমিকরা। কিংবা তারা এসব আদৌ বোঝেন কি না; বা এমন প্রশ্ন তাদের ভাবায় কি নাÑ তাও জানি না। শুধু এটুকু জানি, ওই মালিক ও নেতারা কোনোদিনই এসব শ্রমিকদের তাদের ক্ষমতার রাজনীতির বৃত্তায়ন ও ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থের বাইরে যেতে দেবেন না। এই যে দুদিন যানবাহন বন্ধ থাকল, মালিক-নেতারা নির্দেশ দিলেন, শ্রমিকরা ধর্মঘট করলেন; এই ধর্মঘটও কিন্তু হয়েছে ওই মালিক-নেতাদের স্ব-স্বার্থেই। কারণ যে ইস্যুতে ধর্মঘট, দুই বাসচালকের সাজার বিরুদ্ধে, ইস্যুটি অযৌক্তিক। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যাওয়ার এখতিয়ার শুধু ব্যক্তি বা সংগঠন কেন, রাষ্ট্র বা সরকারেরও নেই। এটি সংবিধান পরিপন্থী। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা এটি ভালো করেই বোঝেন ও জানেন। তারা এ কথাও জানেন, আদালতের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের বিরুদ্ধাচারণ অনৈতিক। এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। ফলাফল ভালো নয়। তারপরও করেছেন। শ্রমিকদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছেন। জনগণকে জিম্মি করে ধর্মঘটের নামে শ্রমিকদের আরেক দফা প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছেন সমাজ ও সভ্যতার এবং কর্ম রীতিনীতি ও সংস্কৃতির কাছে। তা হলে এই ধর্মঘটে লাভ, ক্ষতি-ই বা কার হলোÑ শ্রমিক, শ্রমিক নেতা ও পরিবহন মালিক; নাকি তৃতীয় কোনো পক্ষের? সোজা-সাপ্টা উত্তর, লাভ পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতাদের। বলা নেই, আলোচনা নেই, কাউকে কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়েই ধর্মঘট শুরু হলো তাদেরই নির্দেশে; আবার নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে প্রত্যাহারও হলো তাদেরই নির্দেশে। তার মানে শ্রমিকের শক্তিকে পুঁজি করে এরা নিজেদের ক্ষমতা জাহির করল রাষ্ট্রে, সরকারে, সাধারণ মানুষে। যে দুই মন্ত্রী, তারা শ্রমিক ও পরিবহন মালিক নেতাও, যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ ছিল এই ধর্মঘটে, তারা নিজ ক্ষমতাসীন দলের কাছে ও সরকারে তাদের রাজনৈতিক শক্তির পরীক্ষা দিলেন। বোঝালেন ভোট ও জোরের রাজনীতিতে, যা এই মুহূর্তে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তো বটেই, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও দেশের রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ; সেখানে এই দুই মন্ত্রী বড় নিয়ামক শক্তি। হয়তো এর মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরেক দফা নিশ্চিত হলো এদের মনোনয়ন, গুরুত্ব বাড়ল মন্ত্রিসভায়, পেশিশক্তি ও দখলের রাজনীতিতে আরও একধাপ এগোলো এই দুই শ্রমিক নেতা-মন্ত্রীর দল ও গোষ্ঠী; তেমনি এই দুই মন্ত্রী ও শীর্ষ নেতাদের আরও আস্থাভাজন হলেন মন্ত্রীর বাসায় ধর্মঘটের বৈঠকে অংশ নিয়ে ধর্মঘটে সমর্থন জোগানো সেই অর্ধ শতাধিক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। আর লোকসানে পড়লেন শ্রমিকরা। বরাবরের মতো এবারও ব্যবহৃত হলেন, বঞ্চিতই থেকে গেলেন, ধর্মঘট থেকে কোনো প্রাপ্তি জুটল না তাদের। ভুল বুঝিয়ে ধর্মঘটে নামিয়ে নিঃশর্তভাবেই উঠে যেতে হলো সড়ক থেকে। সেইসঙ্গে শঙ্কা থেকে গেল ভবিষ্যত দুর্ভোগের। কারণ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ডাকা ধর্মঘট কেন অবৈধ হবে না এবং ধর্মঘট আহ্বানকারীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে রুল দিয়েছেন। তার মানে ধর্মঘটের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা নতুন করে দুর্ভোগের মুখে পড়তে যাচ্ছেন। ধর্মঘটের দিন ভাঙচুর ও সরকারি সম্পত্তি নষ্টের অভিযোগে ইতোমধ্যেই পড়েছেন মামলা-মোকদ্দমায়। গাবতলীতে সংঘর্ষের ঘটনায় যে তিনটি মামলা হয়েছে, সেখানে আসামি কেবল সাধারণ শ্রমিকরা, তাও আবার ট্রাক শ্রমিক, ধর্মঘটের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা নেই বললেই চলে। অথচ ধরাছোঁয়ার বাইরে সেই দুই মন্ত্রী, সরকার সমর্থিত অর্ধশত শ্রমিক নেতা ও পরিবহন মালিক; যাদের মদদে এই ধর্মঘটে নেমেছিলেন এসব শ্রমিকরা। তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন; কিছু না বুঝেই ধর্মঘটে নামা এসব বোকা শ্রমিকদের কি হবে! আমি শুধু সরকারকে বলব, আদালত রয়েছে, দেখবেন। কিন্তু জনগণকে জিম্মি করে, আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, যে দুই আইন প্রণেতা ও মন্ত্রী এমন ঔদ্ধত্য দেখালেন; জনগণকে দাঁড় করিয়ে দিলেন রাষ্ট্র ও সরকারের পারঙ্গমতার মুখোমুখি; অনুগ্রহ করে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেবেন সরকার প্রধান। রাজনীতির ক্ষমতার কাছে আমরা এমনিতেই জিম্মি। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা নামতে নামতে শূন্যের কোঠায়। সুতরাং রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সরকারের কাছে জিম্মিদশা ও দুঃশ্চিন্তামুক্ত জীবন কেবল আমাদের চাওয়ায় নয়; দাবিও।
লেখক: সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান