খাদিজার সুস্থতা এবং অবহেলিত চিকিৎসকসমাজ
ডা. জাকির হোসেন
২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর কলেজছাত্রী খাদিজাকে কুপিয়ে আহত করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী বদরুল আলম। ওইদিন পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পর প্রকাশ্যে শতশত শিক্ষার্থীর সম্মুখে বদরুল আলম চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা বেগমকে। গুরুতর আহত অবস্থায় খাদিজাকে প্রথমে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় রাতেই তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে আনা হয়। ঘটনার পর গত বছরের নভেম্বর মাসে খাদিজার ফিরে আসা নিয়ে আমার একটি লেখা দৈনিক আমাদের অর্থনীতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেখানে বিশদভাবে ঘটনার বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। এ ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে টারশিয়ারি লেভেলের হাসপাতালে যে ধরনের চিকিৎসা পাওয়ার দরকার খাদিজা তার প্রত্যেকটিই পেয়েছেন। অত্যন্ত ভাগ্যবতী বলব তাকে। কারণ সে চিকিৎসার গোল্ডেন আওয়ারটুকু চিকিৎসাসেবার আওতায় ছিল। র্দীঘদিন স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন তিনি। চিকিৎসকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে খাদিজা ধীরে ধীর সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন। স্কয়ারের চিকিৎসকা শেষে খাদিজা সাভারের সিআরপিতে চিকিৎসা নিতে যান এবং সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে তার মায়ের কোলে ফিরে গেছেন। সুস্থ্যতার পেছনে সবার, সহযোগিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তার দুঃসময়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও পাশে থাকার জন্য। চিকিৎসকদের প্রতিও তিনি ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
শুধু খাদিজাই নন, প্রতিদিন কতশত খাদিজা কিংবা মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ শিশুকে বাঁচানোর মতো বীরত্বের ইতিহাস আমাদের দেশের সবচেয়ে নিগৃহীত পেশাজীবী চিকিৎসকদের দ্বারা রচিত হয়, তা দেশের নীতি নির্ধারক ফোরাম থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত কেউই অবগত নন। প্রতিদিন সরকারি হাসপাতালগুলোতে যে পরিমাণ অস্ত্রপচার হয় তা বিশ্বের অনেক জনবহুল দেশে থেকেও অনেক বেশি। এ ইতিহাস কেউ-ই জানে না। যে দেশের জনসাধারণ এখনো কবিরাজি কিংবা ওঁঝার ঝাড় ফুঁককে চিকিৎসার প্রধান উপায় বলে মনে করে সেখানে প্রতিটি রোগী চিকিৎসকদের কাছে যখন আসে তার শারীরিক অবস্থা কেমন থাকে তা কেবল একজন চিকিৎসকের পক্ষেই বলা সম্ভব। লিভার ক্যান্সারের রোগীকে জন্ডিস সারিয়ে তোলার নাম করে কবিরাজ লৌহদ- পুড়িয়ে পেট সেকা দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসা হয়। সেখানে চিকিৎসক তার মুমূর্ষু অবস্থার উন্নতি ঘটাতে না পারলে মানুষ অভিযোগ তুলবে, এই দেশের চিকিৎসকেরা কিছুই জানে না। আর রোগীর এই অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে সংবাদপত্রের শিরোনামে আসবে, ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ। যে পরিমাণ লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়ে প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকেরা মৃত্যু সংকটাপন্ন রোগীকে বাঁচিয়ে তুলতে সংগ্রাম করেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এ সকল দৃশ্য সবার সম্মুখে ঘটলেও তা কেউই বুঝবেন না। কারণ চিকিৎসাবিদ্যায় অভিজ্ঞরাই কেবল বুঝতে পারেন, রোগীর শারীরিক অবস্থা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে।
বুঝতে না পারার আরেকটা কারণ হলো, চিকিৎসাবিদ্যার কিছু বাধাধরা নিয়মকানুন। যেমন রোগীর মৃত্যুবরণ করতে যাচ্ছেন, চিকিৎসক একরকম নিশ্চিত তবুও একজন চিকিৎসক সরাসরি তা বলেন না। ইতিবাচক থাকতেন চান। রোগীর অভিভাবকদের বলার চেষ্টা করেনÑ রোগীর খারাপের দিকে যাচ্ছে। কোনো রোগীর ক্যান্সার ধরা পড়লে তা সরাসরি না বলে চিকিৎসকেরা বলেন, এটা একটা টিউমার মনে হচ্ছে। জীবনের শেষ সময়েও একজন চিকিৎসক চান রোগীর জীবনের আশা জাগিয়ে তুলতে। চিকিৎসকের সব চেষ্টারই সুফল বা ইতিবাচক ফল আমরা দেখি তা নয়, তবে তাদের চেষ্টার কমতি থাকে না। চিকিৎসকদেরই আন্তরিকতা, চেষ্টায় খাদিজা মায়ের কোলে ফিরে গেছেন। নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা সব নির্ধারণ করেন। তবে চিকিৎসকদের যে সামর্থ্য সৃষ্টিকর্তা দান করেন তা দিয়ে তারা চেষ্টা করেন। কখনো সফল হন, কখনো হন না। তবে তাদের আন্তরিকতা কখনো কম থাকে না।
শত সীমাবদ্ধ্যতার মধ্যেও চিকিৎসকরা যে চিকিৎসাসেবা দেন তার প্রশংসা তাদের প্রাপ্য। কিন্তু তারা তাদের সেই ন্যায্য পাওনা পান না। হাজারও সফলতার পরেও তাদের বদনাম করা হয়। চিকিৎসক তার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে রোগী বাঁচানোর চেষ্টার পরও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তোলা হয়। সমস্যাটা আসলে কোথায় তা বুঝতে পারছি না। দেশের এই মেধাবী সন্তানদের প্রতি কেন এমন তাচ্ছিল, কথায় কথায় তাদের দায়িত্ব নিয়ে, আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। খুব সুক্ষ্মভাবে এক ধরনের আগ্রাসী ও নির্মম আচরণ করা হচ্ছে দেশের এই মেধাবী সন্তান, চিকিৎসকদের প্রতি। তাদের এই সামাজিক আচরণ চিকিৎসা পেশার প্রতি তাদের ঘৃণা জন্মাচ্ছে। ঘৃণা করতে আসলে শেখানো হচ্ছে, উসকে দেওয়া হচ্ছে কতিপয় কিছু মানুষ। চিকিৎসকদের প্রতি যতœশীল না হলে আমরা এর ভয়াবহ কুফল ভোগ করতে হবে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান