‘যাচ্ছেতাই অবস্থা’ চিকিৎসাসেবায় শৃঙ্খলা আসবে কবে?
ড. বদরুল হাসান কচি
অসুস্থ হয়ে মানুষ ডাক্তারের কাছে ছুটে যায় সুস্থ হওয়ার ভরসা নিয়ে; অপ্রিয় সত্য কথা, এদেশে মানুষ ডাক্তারের কাছেই অনিরাপদ ভাবেন। সার্বক্ষণিক রোগী এবং স্বজনদের নিকট অনাস্থা কাজ করে সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে তো, নাকি ভুল চিকিৎসায় সময়ক্ষেপণ? তার মধ্যে কারণে-অকারণে অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার বোঝা! সুস্থ না হতে পেরে একই রোগের জন্য ভিন্ন ডাক্তার দেখাতে গেলে পূর্বের ডাক্তারের কাঁধে একটি অভিযোগ তুলে দিয়ে নানান কায়দায় আরও পরীক্ষা করিয়ে নেন নতুন ডাক্তার। এর মধ্যে বেশিরভাগ ডাক্তারই প্রেসক্রিপশন লিখেন বিদ্যুৎ গতিতে; ফলে যা ঘটছে তা হলোÑ ওষুধের নাম রোগীর পক্ষে বোঝা তো অসম্ভব, কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে ফার্মেসিগুলোতে। লেখা বুঝতে না পারায় অনেক সময় রোগীকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে এক ফার্মেসি থেকে আরেক ফার্মেসিতে দৌড়াতে হয়; অনেক সময় ব্যর্থ হয়ে পুনরায় ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয় কিংবা ভুল ওষুধ ধরিয়ে দিচ্ছেন ফার্মেসিগুলো। একথাগুলো কোনো গাল্গগপ্প নয়, নিজের অভিজ্ঞতা, দেখা-জানা থেকেই বলছি।
তাছাড়া আমাদের গণমাধ্যমগুলো তো রয়েছে, আরও সত্য জানানোর জন্য। ভুল চিকিৎসাপত্রের কারণে রোগীর নানান দুর্ঘটনার কথা গণমাধ্যমে প্রায় প্রকাশ পায়। এদিকে, এক আইনজীবীর রিটের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি হাইকোর্ট একটি নির্দেশনা দিয়েছেন, ‘পাঠযোগ্য, বড় হরফে বা কম্পিউটার মুদ্রণের মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) লিখতে এবং দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসক যাতে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন সেইজন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এক মাসের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করতে বলা হয়েছে।’ অথচ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের প্রধান শিরোনাম থেকে জানতে পেরেছি, গত দেড় মাসেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোনো সার্কুলার দেওয়া হয়নি। অবশ্য, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে একটি সার্কুলার ইস্যু করেছে।
পাশাপাশি দেশের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে রোগীর রোগ নির্ণয়ে নমুনা পরীক্ষার ফি নিয়ে চলছে নৈরাজ্য। একই নমুনা পরীক্ষার ফি হাসপাতাল ভেদে একেক রকম। শুধু তাই নয়, অনুমোদন ছাড়া ব্যাঙের ছাতার মতো সাইনবোর্ড সর্বস্ব যত্রতত্র গড়ে ওঠা বেশিরভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজি প্রতিষ্ঠানে নিয়ম-নীতির কোনো বালাই নেই। হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দ্বারাই চালানো হয় যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ রোগ নির্ণয়ের কাজ। মনগড়া রিপোর্ট তৈরির মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে প্রতারিত করা হয় অহরহ।
সরকার এখন পর্যন্ত বেসরকারি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক কেন্দ্রগুলোর জন্য ফি নির্ধারণ করে দেয়নি নেই কোনো নির্দেশনা; তাই কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। যদি কোনো নির্দেশনা থাকত তাহলে সবাই তা মানতে বাধ্য থাকত। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গ সরকার (গত ৩ মার্চ শুক্রবার) বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিং হোম ও ক্লিনিকে রোগী হয়রানি বন্ধ করতে বিধানসভায় নতুন বিল পাস করে নিয়েছে। অনলাইনে দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা পড়ে জানতে পেরেছি, ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিক্যাল স্টাবলিস্টমেন্ট (রেজিস্ট্রেশন, রেগুলেশন অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি) অ্যাক্ট-২০১৭’ নামের এই বিলের ওপর আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার চড়া খরচের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘লোভ বাড়তে বাড়তে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে’ এই বিলের গুরুত্ব দিতে গিয়ে তিনি আলোচনায় বাংলাদেশের কথাও বলেন, এখানে বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর মানুষ চিকিৎসা নিতে আসেন। বক্তব্যে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নজরদারির জন্য ১৩ সদস্য বিশিষ্ট রেগুলেটরি কমিশন গঠন করা হচ্ছে। কমিশনকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন হলে কমিশন হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশও দিতে পারে। এই বিলে বলা হয়েছে, প্রতিটি হাসপাতাল ও চিকিৎসককে মানবিক হতে হবে। চিকিৎসার জন্য প্রতিটি হাসপাতালে বিভিন্ন চিকিৎসার প্যাকেজ রাখতে হবে। এই প্যাকেজের অতিরিক্ত কোনো টাকাপয়সা আদায় করা যাবে না। ইনডোর ও আউটডোর চিকিৎসার খরচও নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। দিতে হবে রোগীদের ই-প্রেসক্রিপশন। চিকিৎসার খরচ সম্পর্কে আগেই রোগীকে অবহিত করতে হবে। মানুষ যাতে চিকিৎসা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তিতে না পড়ে, তা নিশ্চিত করতেই এ উদ্যোগ। সাধারণ মানুষের সর্বোত্তম স্বার্থে বাংলাদেশেও এমন একটি আইন সময়ের দাবি রাখে। সরকার এ বিষয়ে গুরুত্ব দিবেন বলে আশা রাখছি।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান