যোগ্য প্রার্থী নেই – এ কথাটি কি সঠিক?
ইকতেদার আহমেদ
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সরকারি ও বেসরকারি উভয়ক্ষেত্রে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি প্রভৃতি আইন অথবা বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো বিভাগে যখন একই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষার ভিত্তিতে সমপদে নিয়োগ দেওয়া হয় তখন লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষায় সম্মিলিতভাবে যিনি সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত হন তাকে জ্যেষ্ঠতম গণ্যে ক্রমান্নয়ে নিম্ন নম্বরপ্রাপ্তদের জ্যেষ্ঠতার তালিকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে চাকরি জীবনে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে কোনোরূপ বিরূপ মন্তব্য না থাকলে জ্যেষ্ঠতার ক্রমের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিধান রয়েছে। বিগত প্রায় দুদশক ধরে সরকারি চাকরিজীবীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার চেয়ে দলীয় আনুগত্য অধিক বিবেচ্য হিসেবে দেখা দিয়েছে। আর এ কারণে সরকারের অনেক বিভাগেই কনিষ্ঠদের দ্বারা জ্যেষ্ঠরা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন। এ ধরনের কনিষ্ঠরা চাকরিতে প্রবেশকালীন নিয়োগ পরীক্ষায় স্বীয় মেধা প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় তারা যে তাদের জ্যেষ্ঠদের চেয়ে শ্রেয়তর এ কথা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। এ ধরনের কনিষ্ঠদের মধ্যে সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও মেধার ঘাটতি থাকায় সরকারের যে সকল বিভাগের শীর্ষ পদে এদের পদায়নের উপক্রম ঘটেছে সে সকল বিভাগের সর্বত্র নৈরাজ্য ও অরাজকতা বিরাজমান। সরকারি কর্মচারিদের জনগণের নিঃস্বার্থ সেবা প্রদান আবশ্যিক কর্তব্য। যেসব বিভাগ কনিষ্ঠদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সেসব বিভাগ হতে দেশের সাধারণ জনমানুষ নিঃস্বার্থ সেবা লাভে বঞ্চিত।
বাংলাদেশে বর্তমানে কতিপয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিশেষত তৈরি পোশাক, মৎস্য প্রজনন, গবাদি পশু প্রজনন, তথ্য প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পর্যটন প্রভৃতিতে বিপুল সংখ্যক বিদেশি কর্মরত রয়েছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে দাবি করা হয় তাদের প্রতিষ্ঠানের যে সকল পদে বিদেশিরা কর্মরত রয়েছে সে সকল পদে পদায়নের জন্য আমাদের দেশে উপযুক্ত ও যোগ্য প্রার্থী নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ সকল প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশিদের সমকক্ষ বা তাদের চেয়ে উঁচুমানের অনেক যোগ্য ব্যক্তি বাংলাদেশে রয়েছে। এ কথাটি অনস্বীকার্য যে, অনেক যোগ্য বাংলাদেশি রয়েছেন যাদের একটি অংশ দেশে উপযুক্ত কর্মপরিবেশ না পেয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন আর অপর একটি অংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান মালিকদের অনীহার কারণে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ লাভে ব্যর্থ হচ্ছেন। আমাদের অনেক বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান মালিক তাদের প্রতিষ্ঠানে বিদেশিদের নিয়োগের বিষয়টিকে তাদের জন্য গর্বের কারণ হিসেবে দেখেন। এমন অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান মালিক রয়েছেন যারা খোড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে বলেন, যে সকল পদে বিদেশিরা কর্মরত রয়েছে এ সকল পদে দেশিয়দের নিয়োগ দেওয়া হলে তারা তাদের নিজস্ব আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনদের নিয়োগ দিয়ে তাদের নিজেদের একটি প্রভাব বলয় সৃষ্টি করবেন যা শিল্প প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু কর্মপরিবেশের জন্য হানিকর।
সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রেও দেখা যায় বিপুল সংখ্যক বিদেশি পরামর্শক এমন সব পরামর্শ সেবাদানে নিয়োজিত যার একটি বিরাট অংশের আমাদের দেশের ক্ষেত্রে বাস্তব প্রয়োগ নেই। বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিশেষত বিশ্বব্যাংক, এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল প্রভৃতি সংস্থা হতে সুদযুক্ত ঋণের মাধ্যমে যে অর্থ সংগ্রহ করা হয় তার একটি বড় অংশ বিদেশি পরামর্শকদের পেছনে ব্যয় হয়। এ ঋণের অর্থ আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। বৈদেশিক ঋণের অর্থায়নে বাস্তবায়িত অধিকাংশ প্রকল্পের পরামর্শ সেবা হতে আমরা কখনো কোনো ধরনের উপযোগিতা লাভ করি না। তাছাড়া প্রকল্প ঋণের সঙ্গে পরামর্শ সেবার বিষয়টি সংযুক্ত বিধায় এটিকে বাদ দিয়ে ঋণ গ্রহণের সুযোগ নেই। যেসব রাষ্ট্র আত্মনির্ভরতার পথে অগ্রসর হতে চায় সেসব রাষ্ট্রের জন্য এ ধরনের পরামর্শ সেবা যুক্ত ঋণ গ্রহণ না করাই উত্তম। কিন্তু আমাদের আমলাদের একটি অংশ ঋণের উপযোগিতার বিষয়টিকে গৌণ ভেবে ঋণের সঙ্গে বিদেশ সফর অন্তর্ভুক্ত কি না সেটিকে মুখ্য বিবেচনায় ঋণ গ্রহণের বিষয়ে স্বীয় অবস্থানে অনড় থাকে। বিদেশি পরামর্শক নির্ভর এ সকল প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে কাজ করার জন্য আমাদের দেশে প্রচুর যোগ্য লোক রয়েছে। কিন্তু দেশিয় পরামর্শকদের নিয়োগ দেওয়া হলে তা আমাদের প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের প্রকল্প হতে অবৈধ অর্থ আহরণের পথ রুদ্ধ করবে এ বিবেচনায় তাদের পক্ষ হতে সবসময় অযৌক্তিকভাবে যোগ্যতার প্রশ্ন তোলে দেশিয় পরামর্শক নিয়োগে বাধা আসে।
সম্প্রতি দুর্নীতি নির্মূলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাটির প্রধানের পক্ষ হতে বক্তব্য আসে যে, আমাদের দেশে যোগ্য প্রার্থী না থাকার কারণে বিভিন্ন খাতে অনেকটা বাধ্য হয়েই বিদেশিদের নিয়োগ দিতে হচ্ছে এবং এ ধরনের কাজে নিয়োজিত বিদেশিরা আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ তাদের নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে। সংস্থাটির প্রধান যে বক্তব্য দিয়েছেন তা তার দেশপ্রেমের অভিব্যক্তি; তবে আমাদের দেশের যে সকল শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিদেশিরা কর্মরত রয়েছে সেসব কর্মে নিয়োগের জন্য আমাদের দেশে উপযুক্ত প্রার্থী নেই বোধকরি এমন উক্তি যথার্থ নয়। আমাদের সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের একশ্রেণির কর্মকর্তা যারা জ্যেষ্ঠ না হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ বিবেচনায় বিভিন্ন বিভাগের শীর্ষ পদে আসীন এদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অসততা ও দেশপ্রেমে ঘাটতির কারণেই আজ আমাদের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এত অধিক সংখ্যক বিদেশি নিয়োগ। এ সকল বিদেশিরা দক্ষ দাবিদারে যে পরিমাণ অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন তা আমাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থের অধিক। এভাবে আমাদের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে দেশে যোগ্য প্রার্থী নেই এ অযুহাতে বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়া অব্যাহত থাকলে আমাদের দেশিয়দের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নিছক অপরিণামদর্শী ও দেশের জন্য হানিকর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা যথাযথ মূল্যায়ন ও পদ প্রাপ্তিতে ব্যর্থ হবে। এ ব্যর্থতা তাদের জন্য যতটুকু না ক্ষতিকর তার চেয়ে বেশি ক্ষতিকর দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য।
দেশের সেনা, নৌ, বিমান, পুলিশ ও প্রশাসনের বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তার শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য হিসেবে অথবা বিশেষজ্ঞ হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্নধর্মী কাজ করার অভিজ্ঞা রয়েছে। এরা সকলেই সফলতা, আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করায় সে সকল দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছেন। এদের অনেকেই আমাদের দেশে কর্মরত বিদেশি বিশেষজ্ঞ বা পরামর্শকদের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু আমাদের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের নিয়োগ সংশ্লিষ্ট খুব কম ব্যক্তি এদের যোগ্যতার বিষয়টিকে যথাযথভাবে মূল্যায়নপূর্বক তাদের পদায়নের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে থাকেন।বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এমন কোনো বিভাগ নেই যাদের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট নেই। দেশে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ প্রতিবছরই কোনো না কোনো প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। আবার কর্মকর্তাদের অনেকে বিদেশেও প্রশিক্ষণের সুযোগ লাভ করেন। একজন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য তার পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি। দেশ ও বিদেশে একাধিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং একাধিক শিক্ষা সফরে গিয়েছেন এমন কর্মকর্তার সংখ্যা বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি খাতে অগণিত। এ ধরনের অগণিত কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও আমরা যদি বলি দেশে উপযুক্ত প্রার্থী না থাকার কারণে বাধ্য হয়ে বিদেশিদের নিয়োগ দিতে হচ্ছেÑ সেটি আমাদের সকলের জন্য দুর্ভাগ্যজনক এবং এর ব্যর্থতার দায় সম্পূর্ণরূপে যারা বিভিন্ন বিভাগের উচ্চপদে আসীন তাদের ওপর বর্তায়।
সম্পাদনা: আশিক রহমান