স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান : বঙ্গবন্ধুর অনন্য এক ভাষণ
ড. অনুপম সেন
লেখক: শিক্ষাবিদ ও উপদেষ্টাম-লীর সদস্য, আওয়ামী লীগ
বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি তার হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৭১ সালেই প্রথম একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এর আগে বাঙালি নিজের জাতিসত্তাকে কয়েক হাজার বছর ধরে রূপ দেয়। আজ যেখানে বাংলা-অঞ্চল সেখানে পু-্রবর্ধন, সুম্ম, রাঢ়, হরিকেল, বরেন্দ্র প্রভৃতি উপজাতি তাদের নাম অনুসারে বসতি স্থাপন করেছিল এবং এসব নামে বিভিন্ন অঞ্চল বা রাজ্যসত্তার অস্তিত্বের খবরও অস্পষ্টভাবে ইতিহাসে পাওয়া যায়। খুব স্পষ্টভাবে আমরা কর্ণসুবর্ণের স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের কথা জানি; জানি, প্রায় চারশ বছর ধরে বাংলা এমনকি বাংলাকে ছাড়িয়ে পাল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল। সেন রাজারাও ছিলেন প্রায় অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় জুড়ে বাংলার এক অংশে। আমরা জানি, সুলতানি আমলে স্বাধীন পাঠান-সুলতানরা বাংলা অঞ্চলকে প্রায় বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে পরিণত করেছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের শেষভাগে মুর্শিদকুলী খাঁ, আলিবর্দি, সিরাজউদ্দৌলা প্রমুখ সুবেদার দিল্লির প্রতি নামমাত্র আনুগত্য স্বীকার করে প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলায় রাজত্ব করেছিলেন। এই দীর্ঘসময়ে বাঙালির বাংলা কোনোদিন রাষ্ট্রভাষা বা সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়নি। রাজসভার ভাষা ছিল সংস্কৃত, পালি বা ফার্সি। সংস্কৃত বা ফার্সি ছিল প্রকৃতপক্ষে রাজন্যবর্গের বা বিদগ্ধজনের সর্বভারতীয় ভাষা। উপমহাদেশের এক প্রান্তের শিক্ষিত মানুষ অন্য প্রান্তের শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে অনায়াসে এই ভাষায় ভাবের আদান-প্রদান করতে পারতেন। তাই প্রকৃত অর্থে স্বাধীন বাংলা রাজ্য মাঝে মাঝে সৃষ্টি হলেও স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র কোনোদিন সৃষ্টি হয়নি ১৯৭১ সালের আগে, যেখানে প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি নিজের জাতিসত্তার স্ফুরণ ঘটিয়ে নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানব অধিকারের স্বীকৃতি পেয়েছে নিজের রাষ্ট্রের সংবিধানে। স্বাধীন রাজ্যে রাজা বা রাজন্যবর্গ স্বাধীন হলেও প্রজারা ছিল পরাধীন, ব্যক্তি ছিল পরাধীন; এমনকি ব্যক্তির প্রাণও চলে যেত রাজন্যবর্গের মুহূর্তের হুকুমে, বিনাবিচারে। ব্যক্তির পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য, প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনতার জন্য বাঙালি এক মরণপণ মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রাম করেছিল ১৯৭১ সালে। ৩০ লাখ লোক আত্মাহুতি দিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনকে পরাভূত করে ছিনিয়ে এনেছিল বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠা করেছিল বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র, প্রজাদের রাষ্ট্র, জনগণের রাষ্ট্র।
১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অসাধারণ ভাষণে বাঙালি জনগণের স্বাধীনতার এই পরম ও চরম আকাক্সক্ষাকে মূর্ত করেছিলেন; স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সবাইকে যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাঙালির উপর অত্যাচারের, নির্যাতনের ও শোষণের চিত্র তুলে ধরেছিলেন অনন্য আবেগে ও তীব্র জ্বালাময়ী ভাষায়, বলেছিলেনÑ রক্ত যখন দিয়েছি, প্রয়োজনে আরও দেবে, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বই ইনশা আল্লাহ। এই ভাষণ এক মহাকাব্যিক দ্যোতনা পেয়েছিল তার শেষ উচ্চারণে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ পেরিক্লিসের পেলোপোনেসিয়ান, আব্রাহাম লিংকনের গেটিস্বার্গ এবং উইনস্টন চার্চিলের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভাষণ প্রভৃতি ভাষণের সঙ্গে এই ভাষণটি বিশ্ব ইতিহাসে স্থান পাবে তার অসাধারণতা ও অনন্যতার জন্য।
কিন্তু অনেকেরই জানা নেই বঙ্গবন্ধু এ রকম আরও একটি অসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর, বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান গ্রহণ উপলক্ষে। সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলার ইতিহাসে বোধ হয় এই প্রথম নজির স্থাপন করল যে, বাঙালিরা তাদের নিজেদের শাসনতন্ত্র প্রদান করছে। বোধ হয় নয়, সত্যিই প্রথমÑ বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের ভোটের মারফতে গণপরিষদে এসে তাদের দেশের শাসনতন্ত্র প্রদান করছেন’ (গণপরিষদে প্রদত্ত ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বরের ভাষণ)। একটি জাতির জন্য তার শাসনতন্ত্র নিজে রচনা করা কি বিরাট প্রাপ্তি, কি অসাধারণ অর্জন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা জানি, আমেরিকার শাসনতন্ত্র বা সংবিধান কি গভীর যতেœ ও পরিশ্রমে গ্রহণ করা হয়েছিল ওয়াশিংটন, এডামস, হ্যামিলটন, ফ্রাঙ্কলিন প্রমুখ বিরাট সব প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদদের অমেয় জ্ঞানের প্রয়োগে।
দুই. বাংলাদেশে ১৯৭২-এর শাসনতন্ত্র বা সংবিধানও রচনা করা হয়েছিল আওয়ামী লিগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর গভীর প্রজ্ঞার আলোকে। বিশ্বের মহৎ সব সংবিধান বিশ্লেষণ করে তাদের শ্রেষ্ঠ অর্জনগুলো চয়ন করা হয়েছিল বাংলাদশের সংবিধানে তা দেশোপযোগী, যুগোপযোগী করে। এই সংবিধান গ্রহণ করার সময় বঙ্গবন্ধুর মনে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, তার উপর নির্মম শোষণের ইতিহাস যেমন তীব্রভাবে কাজ করেছিল, তেমনি জাগ্রত ছিল তা থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা। বাঙালির উপর বহু শতাব্দীব্যাপী যে অর্থনৈতিক শোষণ অব্যাহত ছিল মুঘল আমল থেকে, তা তার অন্তরে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। তাই তিনি এই শোষণের কথা বলেছেন গভীর বেদনায়, যদিও তা মাত্র সংক্ষিপ্ত কয়েকটি বাক্যে, ‘দুনিয়ার সেইসব লোভীরা এবং তদানীন্তন ভারতবর্ষের যারা শাসক ছিল, তারা বাংলার অর্থ, বাংলার সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে অন্যত্র। গৃহহারা, সর্বহারা, কৃষক, মজুর, দুঃখী বাঙালি যারা সারাজীবন পরিশ্রম করেছে, দুবেলা পেট ভরে খেতে পায়নি, তাদেরই সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে কলকাতার বন্দর, বোম্বাই, মাদ্রাজ; তাদেরই সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে করাচি, ইসলামাবাদ, লাহোর, গড়ে উঠেছে ডান্ডি, গ্রেট ব্রিটেন। এই বাংলার সম্পদ ছিল বাঙালির দুঃখের কারণ’ (ওই ভাষণ)।
বাংলার সার্বিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে বা শাসনতন্ত্রে চারটি মূল পন্থা বেছে নেওয়া হয়েছিল; সেগুলো হলোÑ জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। শাসনতন্ত্রের এই মূল বা স্তম্ভগুলোকে বঙ্গবন্ধু তার অনন্য ভাষায় ব্যাখ্যা করেছিলেন ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বরের এই ভাষণে। এই চারটি স্তম্ভের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, এগুলো বাঙালির অর্জন বহু প্রাণের বিনিময়ে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে, ‘এই যে চারটা স্তম্ভের উপর শাসনতন্ত্র রচনা করা হলো এর মধ্যে জনগণের মৌলিক অধিকারই হচ্ছে মূলবিধি। মূল চারটা স্তম্ভ জনগণ ভোটের মাধ্যমে এর অস্তিত্ব প্রমাণ করে দিয়েছে। শুধু ভোটের মাধ্যমে নয়, ৩০ লাখ লোক জীবন দিয়ে, রক্তের মাধ্যমে তা প্রমাণ করে দিয়েছে’ (ওই ভাষণ)।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা তিনি এভাবে করেছেন, ‘জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চরম মরণ সংগ্রামে। জাতীয়তাবাদ না হলে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে আমরা এগিয়ে গিয়েছি। …এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন, সকলের সঙ্গে একটা জিনিস রয়েছে, সেটা হলো অনুভূতি। …অনেক দেশ আছে একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সবকিছু, কিন্তু সেখানে বিভিন্ন জাতি গড়ে উঠেছে, তারা একটি জাতিতে পরিণত হতে পারেনি। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর। আজ বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে; এই সংগ্রাম হয়েছিল যার উপর ভিত্তি করে সেই অনুভূতি আছে বলেই আজকে আমি বাঙালি, আমার বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ (ওই ভাষণ)। অতি সাধারণ ভাষায় তিনি জাতীয়তাবাদের যে গভীর ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা সত্যিই অনন্য। তিনি প্রথমেই বলেছেন, জাতীয়তাবাদ না হলে একটি জাতি এগোতে পারে না। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমরা জানি, পলাশীর যুদ্ধে জয়ী হয়ে ক্লাইভ সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করেছিলেন, তাকে কেউ বাধা দেয়নি। ক্লাইভ ব্রিটিশ সংসদীয় কমিটির কাছে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, মুর্শিদাবাদের অধিবাসীরা যদি সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাকে বাধ্য দিত, তাহলে তার পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হতো না। বস্তুত পলাশীর যুদ্ধ যখন চলছিল তখন আশেপাশের কৃষকরা নিরুদ্বিগ্নভাবে চাষ করে যাচ্ছিল। জনগণের মধ্যে কোনো চাঞ্চল্যই পরিলক্ষিত হয়নি। তারা ভেবেছে এক রাজা যাবে, আরেক রাজা আসবে তাতে তাদের কী। তারা বুঝতেই পারেনি দেশের জন্য কী বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। জাতীয়তাবাদ হলো তাই, যখন সাধারণ লোকের মধ্যেও এই অনুভূতি জাগে যে, দেশের স্বার্থই সবার স্বার্থ, দেশের মঙ্গল-অমঙ্গলই প্রতিটি ব্যক্তির মঙ্গল-অমঙ্গলের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই একাত্ম অনুভূতিই জাতীয়তাবাদ। বিভিন্ন আরব দেশে যেমনÑ সিরিয়া, ইরাক, মিশর, সৌদি আরবে জনগণের ভাষা ও ধর্ম এক, কিন্তু তারা ভিন্ন ভিন্ন জাতি। কারণ তাদের জাতীয়তাবাদের অনুভূতি ভিন্ন। একইভাবে ইংল্যান্ড, আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াও ভিন্ন; কারণ তাদের জাতীয়তাবাদের অনুভূতি ভিন্ন। বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদের মূল যে অনুভূতিতেই নিহিত, সহজ-সরল ভাষায় তারই অসাধারণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। (চলবে-১)
সম্পাদনা: আশিক রহমান