শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন নয়
শাহানুজ্জামান টিটু: একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে বিএনপির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা চলছে। দলটির নেতাদের মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ও না নেওয়ার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্তি নিয়ে কানাঘুষা চলছে। দলের মধ্যে কেউ কেউ একটু ছাড় দিয়ে হলেও নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে। কিন্তু আরেকটি পক্ষের মতে সরকারকে ছাড় দিয়ে নয় বরং চাপে রেখে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি আদায় করে সেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে। দলটির নীতি নির্ধারণী ফোরামের প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, যেকোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়াটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত। আমি সবসময় নির্বাচনের পক্ষে। এর ফলে কি হয় আপনি নির্বাচনে গেলেন না, তাতে কি হলো সরকারও গঠন করতে পারলেন না আবার বিরোধী দলেও থাকতে পারলেন না। দুদিক থেকে ক্ষতি হয়ে গেল। রাষ্ট্রীয় প্রোটোকলের বাইরে থাকতে হয়। সংসদে দলের পক্ষে কথা বলার কেউ থাকে না। ফলে ক্ষমতাসীনরা যা ইচ্ছে খুশিমতো বিএনপির বিরুদ্ধে বলে বেড়াচ্ছে।
অপরদিকে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমরা নির্বাচনিমুখী দল অবশ্যই আমরা নির্বাচন করতে চাই, নির্বাচনে যেতে চাই। কিন্তু তার আগে দেখতে হবে ওই সময় নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্বে কারা রয়েছেন। শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে।
নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি বা কনসেপ্ট বর্তমান ক্ষমতাসীন দল যদি না মানে তাহলে কী করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনগণের এই দাবি সরকার যদি না শোনে তাহলে আমাদের বসে থাকলে তো চলবে না। এই দাবি আদায়ে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া আমাদের সামনে বিকল্প আর কী পথ থাকতে পারে। বিএনপি তো কোনো সন্ত্রাসী বা বিদ্রোহী দল না এটা জনগণের একটি দল। তাই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা আন্দোলনে যাব।
সেই আন্দোলনের ধরন কেমন হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জনগণকে মুক্তি দিতে এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী বিএনপি কঠোর কর্মসূচি হাতে নেবে।
এদিকে আগামী নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশ না নেয় তাহলে তাদের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হবে। কিন্তু সেটা নিয়ে বিএনপির খুব বেশি মাথাব্যথা নেই। কারণ দলটির নেতারা মনে করেন নিবন্ধন বাতিলের এই হুমকিতে ভীত নন তারা। এবং এই ফাঁদে পা দিয়ে বিএনপি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রেখে নির্বাচনে যাবে না।
দলটির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন মনে করেন অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন নির্বাচনে অংশ না নিলে নিবন্ধন বাতিল হতে পারে। কিন্তু আমরা বলতে চাই ওই ভয় দেখিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনে আনা যাবে না। ওই ফাঁদে পা দিয়ে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না।
এদিকে দলের মধ্যে যারা নির্বাচনে যাওয়ার বিষয় নিয়ে ভাবছেন তাদের যুক্তি হলো বিগত নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপিকে নানা ধরনের ধকল সইতে হচ্ছে। বর্তমান সরকার বিনাভোটে পাঁচ বছর পার করতে যাচ্ছে কিন্তু বিএনপি এই সময়ের মধ্যে কোনো কিছুই করতে পারেনি। আবার সরকার ও বিরোধী দলের কোনোটাই না থাকায় বিএনপিকে না ঝঁক্কিঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের বাইরে থাকায় দলের প্রধান খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয় কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না। বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বাংলাদেশ সফরে আসলে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য দেন দরবার করতে হয় কূটনৈতিক পর্যায়ে। এমনকি দলের প্রধানকে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে গিয়ে সেখানে অপেক্ষা করতে হয়। হাজার হাজার মামলা মাথায় নিয়ে বিএনপিকে ঘুরতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার ক্ষমতা ভাগাভাগির কথা বলেছিল তেমন যদি প্রস্তাব সরকার থেকে আসে তাহলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে। দলটির একাধিক সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে। তবে এ ব্যাপারে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না।
তবে দলের অপর একটি অংশ এই যুক্তিকে মানতে চাচ্ছে না। কারণ তারা মনে করেন তাই যদি হবে তাহলে বিএনপিকে দশ বছরের অধিক সময় ক্ষমতার বাইরে থাকতে হতো না। খালেদা জিয়াসহ নেতাকর্মীদের জেল, হত্যা, গুম, মামলা হামলার মুখোমখি হতে হতো না। তারা মনে করেন শেখ হাসিনার ওই প্রস্তাব মেনে নেওয়া হলে বিএনপি জনগণ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ত। কারণ জনগণ বিএনপির সঙ্গে আছে বলেই ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন প্রহসনের একটি নির্বাচন করতে বাধ্য হয়েছে। র্দীঘ সময় ধরে সরকারের জেল, জুলুম, নির্যাতন, হামলা, মামলা এসব সহ্য করে আসছে নেতাকর্মীরা। তাদের এই ত্যাগ একটি কারণে আর সেটা হলো বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রেখে কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। তাই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার হতে হবে। কারণ ইতোমধ্যে সরকার নিজেদের পছন্দের লোক দিয়ে ইসি গঠন করেছে।
বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং এই ইসির অধীনে নির্বাচন কতটা নিরপেক্ষ ও সুষ্টু হবে তা নিয়ে তাদের সংশয়ের কথাও বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করছে।
অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইচ্ছা ও দলের ভেতরে নির্বাচনি প্রস্তুতি রেখে বিএনপি একটি দাবিতে এখনো একাট্টা, যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে। সেটা যে নামেই হোক অবশ্যই নির্বাচনকালীন সহায়ক একটি সরকার চায় তারা। দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া অনেক আগে থেকেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রেখে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন।
দলটির একজন নীতিনির্ধারক বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে বিগত যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তার ফলাফল কি দাঁড়িয়েছে তা সবাই দেখেছেন। বিএনপি যদি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে তাহলে আমরা বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার অধীনে আগেই করতে পারতাম। কিন্তু বিএনপি সেটা করেনি।
তিনি বলেন, দলের প্রধান থেকে শুরু করে একেবারেই তৃণমুল পর্যন্ত হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে অসংখ্য মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। আমাদের নেত্রীকে তার এই বয়সে কিভাবে মিথ্যা মামলায় নাজেহাল করা হচ্ছে। সপ্তাহে দুই তিনদিন তাকে কোর্টে হাজিরা দিতে হচ্ছে। এক হাজারের অধিক দলীয় কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত মিথ্যা পরোয়ানা নিয়ে দলের নেতাকর্মীরা তাদের ঘর ও পরিবার ছাড়া হয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এত কিছু তো হতো না যদি আমরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এই হাসিনার অধীনে করতাম। তাই আমাদের পরিষ্কার কথা শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে যাওয়ার ইচ্ছা বিএনপিতে নেই। তাই যদি হতো তাহলে অনেক আগেই সরকারের সঙ্গে সমঝোতা হয়ে যেত। সম্পাদনা: এনামুল হক