কুকুর ও মানুষের সভ্যতা
কামরুল আহসান : একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন, ঢাকা শহরে খুব দ্রুত হারে কুকুরের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিটা এলাকায় কুকুরের ঘেউ ঘেউ। প্রায়ই ওদের মহাসম্মেলন বসে। নগর কর্তৃপক্ষ এখন আর তেমন কুকুরনিধন করে না। কিছুদিন আছে চট্টগ্রাম শহরে বিষ প্রয়োগে কুকুর মারা হচ্ছিল। তখন এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উঠেছে চট্টগ্রামসহ খোদ রাজনধানী শহর ঢাকাতেও। অনেকে তাদের প্রিয় পোষা কুকুর নিয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে।
আশ্চর্য ব্যাপার হলো, কুকুরগুলো সারাক্ষণ ঘেউ ঘেউ করলেও আগের মতো আর কামড়ায় না। মোটামুটি মানুষের সভ্যতার সাথে তারা মোটামুটি মিলেমিশে গেছে। তারাও বোধহয় বুঝতে পেরেছে মানুষকে কামড়ালে মানুষের এই সমাজে তারা টিকতে পারবে না। তবু কেউ কেউ নিশ্চয়ই কামড়ায়। যারা পাগলা হয়ে যায়। তেমন তো কিছু মানুষের মধ্যেও দেখা যায়। মানুষ হয়েও মানুষের সভ্যতার সাথে তারা মিলেমিশে চলতে পারে না। তাদেরকেই সম্ভবত বলা হয় কুকুরের চেয়ে অধম।
গত বছর তেল-গ্যাস বিদুৎ বন্দর রক্ষার জন্য শাহবাগে আন্দোলনে নেমেছিল একদল তরুণ-তরুণী। তখন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে আন্দোলনকারীদের। পুলিশ এক তরুণীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিবার করেছিল একটি কুকুর। পুলিশ যখন নারীটিকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন রাস্তার একটি কুকুর এসে নারীটির জামা কামড়ে ধরে।
কুকুরই নাকি মানুষের প্রথম পোষমানানো প্রাণী। ব্যাপারটা উল্টোও হতে পারে অবশ্য। হয়তো কুকুরই মানুষকে পোষ মানিয়েছে। কুকুর দেখল মানুষ মাংসটা খেয়ে হাড্ডিটা ছোড়ে ফেলে দেয়, যেটা কুকুরের দরকার। হয়তো সেদিন থেকেই কুকুর মানুষকে শিকার করেছে। কুকুরকে যদি আপনি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে তার থেকে একটা দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন। কুকুরের সাথে মানুষের পার্থক্য কোথায় এটা একটা দার্শনিক প্রশ্ন।
কুকুরে সাথে আসলে মানুষের মূল পার্থক্যগুলো কী কী?
কুকুর খায়, ঘুমায়, প্রজনন করে, বাচ্চা উৎপাদন করে, সেগুলোকে লালন পালন করে, মানুষও তো তাই করে। তাহলে পার্থক্যটা ঠিক কোথায়? কতোদূর? কেন মানুষ নিজেকে দাবি করে সৃষ্টির সেরা জীব!
সক্রেটিস বলেছিলেন, পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গ-উদ্ভিদের সাথে যদি তোমার জীবনের কোনো পার্থক্য না থাকে তাহলে তোমার জীবনের মূল্য কী?
দার্শনিক ডায়জেনিস নিজেকে কুকুর বলেই পরিচয় দিতেন। তাকে যে খাবার দিত তার দিকে তাকিয়ে গোঁৎ গোঁৎ করতেন, যে না দিতো তার দিকে ঘেউ করে উঠতেন। ডায়জেনিস বলেছিলেন, কুকুর আর দার্শনিকরা সমাজের সর্বোচ্চ মঙ্গলসাধন করে কিন্তু তারাই হয় সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত। ডায়জেনিসের সাথে সব সময়ই একটা কুকুর থাকতো। নিজের খাবার তিনি কুকুরের সঙ্গে ভাগ করে খেতেন। ডায়জেনিসের মতো আরেকজন আছেন তান্ত্রিক তিলোপা। যিনি কুকুরকে নিজের বন্ধুর মতো কাছে রাখতেন। তান্ত্রিক তিলোপা একদিন মানুষের খুলিতে করে খাবার খাচ্ছিলেন। তার সাথে খাচ্ছিল এক কুকুর। এক ভক্ত বহুদূর থেকে এসেছে তার কাছে তন্ত্রমন্ত্র দীক্ষা নিতে। এসে দেখে এই অবস্থা। গুরু মানুষের খুলিতে করে খাবার খাচ্ছে। তার সাথে আবার এক কুকুর। তিলোপা বললেন, আসো, আসো, আমরা তো খাওয়া শুরু করে দিছি। আসো, বসো, খাও।
ভক্ত ভয়ে ভয়ে বলল, মানুষের খুলিতে করে খাবো!
তিলোপা বললেন, তাতে কী সমস্যা? মানুষের খুলি পাত্র হিসেবে ভালো। শক্তপোক্ত, মজবুত। আর একটা একদম পরিস্কার। আসো। ভক্ত এবার গা-ঘুলিয়ে বলল, কিন্তু, কুকুরটা! তিলোপা বললেন, কুকুর তাতে সমস্যা কী? তোমার ভিতরে তো একটা কুকুর আছে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি তার ভিতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে…
সত্যিই কি মানুষের ভিতরে একটা কুকুর থাকে? মানুষ কুকুরের চেয়ে অধম না উত্তম এই নিয়ে বহু তর্ক হয়েছে। আমার মনে হয় না মানুষ কুকুরের চেয়ে অধম। কিছু মানুষ হয়তো কুকুরের চেয়ে অধিক হিং¯্র হয়, কিন্তু, মানুষ যদি একবার সত্যিকার অর্থে মানুষ হয়ে উঠতে পারে তাহলে তার অনুভূতির জগত ¯্রষ্টাকে স্পর্শ করতে পারে। মানুষই একমাত্র ধারণ করতে পারে এই মহাজগতের সমস্ত ব্যাপ্তি, এই বিশ্বজগতের সবকিছুকে একমাত্র মানুষই ভালোবাসতে পারে নিঃস্বার্থভাবে।
পশুপাখিও সেটা পারে কি-না আমরা অবশ্য তা জানি না। আমরা আক্ষরিক অর্থেই ওদের সম্পর্কে খুব জানি। আমাদের পাশেই থাকে, আমাদের প্রতিবেশীর মতো, কিন্তু, ওদের সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না।
মওলানা রুমি নিজেকে খোদার কুকুর বলতেন। কুকুর যেমন প্রভুর জন্য কাঁদে, রুমি বলতেন, আমি সেভাবে আমার খোদার জন্য কাঁদি।
মহাভারতের শেষ পর্ব স্বর্গাহরণ পর্ব। যদুবংশ ধ্বংসের পর সত্যবাদী যুধিষ্ঠির চার ভাই ও দ্রৌপদিকে নিয়ে মহাপ্রস্থানের দিকে যাত্রা শুরু করেন। পথিমধ্যে ভীম, অর্জন, নকুল, সহদেব এবং দ্রৌপদী নিজেদের কিছু ছোটখাট পাপের জন্য একে একে পথে মরে পড়ে যেতে থাকে। তারা স্বর্গে যেতে পারেন না। তাদের সঙ্গে একটি কুকুরও সঙ্গী হয়ছিল। স্বর্গদ্বারে উপস্থিত হন একমাত্র যুধিষ্ঠির, সাথে সেই কুকুর। তখন দেবরাজ ইন্দ্র এসে বলেন যুধিষ্ঠিরকে, স্বর্গে যেতে হলে কুকুরকে রেখে যেতে হবে। এই ইতরপ্রাণীকে নিয়ে স্বর্গে যাওয়া যাবে না। তখন যুধিষ্ঠির বলেন, প্রভুভক্ত কুকুর ছাড়া স্বর্গে প্রবেশ করলে তা নির্দয়তার পরিচয় হবে। যুুধিষ্ঠির কুকুর ছাড়া স্বর্গে যেতে চান না। তখন কুকুররূপধারী ধর্ম আবির্ভূত হন। আসলে ধর্মই কুকুরের রূপ ধরে ছিল। ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেন, যুধিষ্ঠির, তোমার সমান স্বর্গে কেউ নেই।
কুকুরের কথা মনে হলেই আমার লাইকার কথা মনে পড়ে। লাইকা হচ্ছে মহাশূন্যে পরিভ্রমণকারী পৃথিবীর প্রথম প্রাণী। রুশ নোভযান স্পুতনিক টু-তে করে তাকে মহাশূন্যে পাঠানো হয়। লাইকা আর কোনোদিন ফিরে আসে নাই এই পৃথিবীতে। অনন্ত মহাশূন্যে সে হারিয়ে গিয়েছিল একা। সম্পাদনা: পরাগ মাঝি