‘নোবেল আমাকে পেতেই হবে, আমি স্বপ্ন দেখি নোবেলের’
স্বকৃত নোমান
বইমেলার শেষদিন বিকেল। কয়েকজন লেখক মিলে বসে আছি অনিন্দ্য প্রকাশের স্টলের সামনে। বয়োবৃদ্ধ এক নারী এসে দাঁড়ালেন আমাদের সামনে। দুই কাঁধে দুটি ব্যাগ। দুটি বই বের করে আমাদের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন: ‘আমার বইগুলো একটু দেখুন।’ লেখক মোশতাক আহমেদ হাতে নিলেন বই দুটি। উল্টেপাল্টে দেখে একটি বই কিনে নিলেন। আনন্দের একটা ঢেউ আছড়ে পড়ল লেখিকার মুখম-লে। এবার তিনি আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন একটি বই: ‘নিঝুম দ্বীপের মহাকাব্য।’ উল্টেপাল্টে দেখছি আমি। খারাপ নয় লেখা। বানানেও বেশ সতর্ক। বললেন, নিন একটি বই। বললাম, ‘এখন তো টাকা নেই, পরে নিই? আপনি বরং বসুন এখানে, কথা বলি।’ পাশের চেয়ারটি এগিয়ে দিল তরুণ লেখক আজহারুল হক ফরাজী। বসলেন তিনি।
কথায় কথায় জানা গেল ড. আকন্দ সামসুন নাহার নামের এই লেখিকার বর্তমান কর্মস্থল এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। শিক্ষা ও ট্রেনিং বিভাগের প্রধান ও ডিন। দীর্ঘসময় সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন ন্যাশনাল কারিকুলাম অ্যান্ড টেক্সট বুক বোর্ডে। ২০০১ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যান। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি এখনো এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ডিন?’ বললেন, ‘হ্যাঁ। কিন্তু বয়স হয়ে গেছে বলে ছেলে-মেয়েরা এখন ইউনিভার্সিটিতে যেতে দেয় না।’ জানালেন, গত কবছর ধরে তিনি লেখালেখিতে নিবিষ্ট। এ যাবৎ প্রায় কুড়িটি গল্প-উপন্যাসের বই বেরিয়েছে। মৃত্যুর আগে একশটি বই লিখতে চান। এরই মধ্যে একটি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদও করিয়েছেন। কারণ তিনি নোবেল পেতে আগ্রহী। আমার কাছে জানতে চাইলেন, নোবেল কমিটির কাছে কী উপায়ে বই পাঠানো যায়? বললাম, ‘সে তো অনেক ঝামেলার ব্যাপার। কিন্তু আপনি কেন মনে করছেন আপনি নোবেল পাওয়ার যোগ্য?’ বললেন, ‘আমার মন সাক্ষী দেয় আমি অনেক ভালো লিখি। আমাকে নোবেল দেওয়া উচিত।’
আচমকা তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, তুই কি সাংবাদিক? এত কথা জিজ্ঞেস করছিস ক্যান?’ না আমি পাঠক। বই পড়ি। কোন ক্লাসে পড়িস? তোকে দেখে তো মনে হয় না তুই ছাত্র। কোন ইউনিভার্সিটি? আমি বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়? ওটার ক্যাম্পাস কোথায়? ক্যাম্পাস সারাবিশ্ব। তুই দুষ্টুমি করছিস আমার সঙ্গে? না না, সত্যি বলছি। আমি পাঠক। বই পড়ি। আমার বইটা পড়! পড়ব। তার আগে আপনার সঙ্গে কথা বলি। আপনার আপত্তি নেই তো? না না আপত্তি থাকবে কেন? বল। কথা চলতে লাগল আমাদের। তিনি জানালেন, প্রতিবছরই তার বই প্রকাশিত হয়। নিজ উদ্যোগে বের করেন। এবার বেরিয়েছে দুটি বই, কনকর্ড টাওয়ারের একটি প্রকাশনী থেকে। এজন্য প্রকাশককে দিতে হয়েছে চল্লিশ করে আশি হাজার টাকা। প্রকাশক তাকে এ যাবৎ বই দিয়েছেন মোট দেড়শ করে মোট তিনশ কপি বই। আরও তিনশ কপি দেওয়ার কথা, কিন্তু আজ দেবেন কাল দেবেন করে দিচ্ছেন না। বললাম, ‘দুই বইয়ের তিনশ কপি তো পেলেন, এগুলো কি বিক্রি শেষ?’
না, আরও কিছু বাকি আছে। আজ কটি বিক্রি করলেন? এই সাত-আটটি। বেশ বেশ। কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে। বল। লেখক লিখবেন, প্রকাশক বই ছেপে বিক্রি করবেন। দুজনের কাজ আলাদা। আপনি একইসঙ্গে লিখছেন এবং বিক্রিও করছেন। কেন?’ আমি সবার কাছে পরিচিত হতে চাই। বিখ্যাত হতে চাই। এভাবে কি বিখ্যাত হওয়া যায়? হচ্ছি তো। পত্রপত্রিকায় এবং টিপে টিপে কী একটা করে না? ওই যে টিপে টিপে… সেখানে আমাকে নিয়ে লেখা হয়েছে। টিপে টিপে কোনটা? ফেসবুক? হ হ, ফেসুবক। আছে তোর কাছে ওটা? কিন্তু এভাবে বিখ্যাত হওয়ার মধ্যে কি কোনো মহাত্ম্য আছে? পত্রপত্রিকায় তো কত মানুষের ছবি আর কথা ছাপা হয়। আপনি তো লেখক। আপনি বিশেষ মানুষ। আপনার কি উচিত এই উপায়ে বিখ্যাত হওয়া? কী করব? আমার বই কেউ কেনে না, বুঝলি? কেউ ছাপে না। তাই নিজেই ফেরি করে বেড়াই।
তার মুখটি ছেয়ে গেল হতাশার কালো মেঘে। সহসা কেটেও গেল। উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘নোবেল আমাকে পেতেই হবে। আমি স্বপ্ন দেখি নোবেলের।’ স্বপ্ন দেখা ভালো। মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়। আচ্ছা, তুই তো খালি কথা বলছিস, আমার বই কিনবি না?’ অবশ্যই কিনব। কিন্তু তার আগে লেখালেখির প্রতি আপনার এই ভালোবাসার কথা ওই যে ‘টিপে টিপে’…ওটাতে জানাতে চাই। সবাই আপনার কথা জানুক এবং আপনার বই পড়ুক। আপনার কি আপত্তি আছে? না না আপত্তি থাকবে কেন? আমি তো চাই আমার বই সবাই পড়ুক। আপনার জন্য শুভকামনা। ভালো থাকবেন সবসময়। তুইও ভালো থাকিস।
তিনি উঠে চলে গেলেন। দুই কাঁধে দুটো ব্যাগ। আমি তাঁর চলে যাওয়া দেখি। কিছু দূর গিয়ে দাঁড়ালেন। ব্যাগ থেকে দুটো বই বের করে একজনের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু উপেক্ষিত হলেন। আবার তিনি হাঁটা ধরলেন। আবার বই দুটো বাড়িয়ে ধরলেন আরেকজনের দিকে। আবারও উপেক্ষিত হলেন। হয়তো তৃতীয়বারের মতো উপেক্ষিত হবেন। কিন্তু চতুর্থবার হবেন না। মোশতাক ভাইয়ের মতো কোনো সহৃদয়বান মানুষ কিনে নিবেন একটি বই। তিনি বিপুল উৎসাহে আবার এগিয়ে যাবেন। আবার উপেক্ষিত হবেন। আবার… আবার।
লেখক: কথাসাহিত্যিক/সম্পাদনা: আশিক রহমান