কৃষিক্ষেত্রে নারীর অবদান ও মজুরি বৈষম্য
মো. ওসমান গনি
কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমানতালে এগিয়ে চলছে। যেকোনো কাজ নারীরা এখন করতে পারে। এমন কোনো কাজ নেই যে তারা করতে পারে না। আমরা একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এখানকার বেশির ভাগ নারীই কোনো না কোনোভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। আমাদের বেশির ভাগ মানুষই বসবাস করেন গ্রামে। গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। গ্রামের নারীরা এখন পুরুষের পাশাপাশি কৃষিকাজেও বিশাল অবদান রাখছেন। কিন্তু তারা ন্যায্য মজুরি পান না। এখানে এটা বহুকাল থেকেই চলে আসছে। পুরুষের পাশাপাশি সমান কাজ করেও নারীরা মজুরি পায় পুরুষের অর্ধেক। পুরুষ ও মহিলার মাঝে মজুরির যে বৈষম্য তা দূর করার জন্য বহুবার আন্দোলন করেও তার কোনো ফল আসেনি। তাই জাতীয় কবি লিখেছেন, ‘শস্যক্ষেত্র উর্বর হলো, পুরুষ চালাল হল/নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল/নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে/ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে!’
কৃষিতে নারীর অবদানের এমন স্বীকৃতি অনেক আগেই দিয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। অথচ এতকাল পরেও রাষ্ট্রীয়ভাবে কাজের স্বীকৃতি মেলেনি তাদের। এমনকি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে পুরুষ কৃষকের জন্য সুনির্দিষ্ট ডাটাবেজ থাকলেও নারী কৃষকের ডাটাবেজ নেই। নারীরা মজুরি পান পুরুষের অর্ধেক। অথচ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, নারীর শ্রমশক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বিভিন্ন সমীক্ষা অনুযায়ী কর্মজীবী নারীর অর্ধেকের বেশি কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন। দেশে কৃষি খাতে নিয়োজিত নারীর সংখ্যা ৯০ লাখ ১১ হাজার। নারীরা ফসল উৎপাদনে মাঠে যেমন কাজ করেন, তেমনি মাঠের বাইরের উৎপাদন কাজেও বড় ভূমিকা রাখেন। অথচ জমিতেও নারীর মালিকানা কমছে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইটের কৃষিতে নারী শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জমির মালিকানা পুরুষের ৮১ শতাংশ, নারীর ১৯ শতাংশ। ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, এত ভূমিকা রাখার পরও ৪৬ শতাংশ নারীর স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার জন্যও স্বামীর অনুমতি নিতে হয়। এখনো কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে ছয় শতাংশ নারী স্বামীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাদের কাজের অবদানও স্বীকৃতি পায় না।
শুধু কৃষি নয়, নারীর কর্মক্ষেত্রকে অর্থনীতির মূলধারার বাইরে রেখে বিবেচনা করার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান এখনো ২০ শতাংশ মাত্র। রান্নাবান্না, শিশু পরিচর্যাসহ গৃহস্থলির কোনো কাজেরই অর্থনৈতিক মূল্য নেই। পুরুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি সময় ধরে গৃহস্থলির কাজ করেন নারীরা। তবুও এ কাজের মূল্যায়ন নেই। ২০১৪ সালে প্রকাশিত বিবিএসের ‘সময় ব্যবহার’ জরিপে দেখা গেছে, কর্মজীবী একজন পুরুষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থের বিনিময়ে ছয় ঘণ্টা ৫৪ মিনিট কাজ করেন। অর্থের বিনিময়ে নারীর কাজের সময় পাঁচ ঘণ্টা ১২ মিনিট।
তবে একজন কর্মজীবী নারী বাসায় ফিরে দৈনিক গড়ে তিন ঘণ্টা ৩৬ মিনিট গৃহস্থলির কাজ করেন। পুরুষেরা ঘরের কাজে গড়ে মাত্র এক ঘণ্টা ২৪ মিনিট সময় ব্যয় করেন। তবে রান্নাবান্না, সন্তান লালন-পালনসহ গৃহস্থলির কাজকর্মের স্বীকৃতি নেই মোট জিডিপিতে। এই শ্রমের আর্থিক মূল্যমানও নির্ধারণ করা হয় না। এর ফলে অর্থনীতিতে নারীর এ কাজের অবদান আড়ালেই থাকছে। বাংলাদেশে এক কোটি ছয় লাখ লোক গৃহস্থলির কাজ করেন। তাদের সিংহভাগই নারী।
পাঁচ থেকে ছয় কোটি নারী বিভিন্ন ধরনের কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তবে তাদের অর্থনৈতিক অবদানের মূল্যায়ন বা স্বীকৃতি তারা পাচ্ছেন না। গ্রামীণ জীবনযাত্রায় স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচার অভিযানের ২০১২ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশে মোট নারী শ্রমশক্তি এক কোটি ৬২ লাখ। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী। যার ৬৮ শতাংশ কৃষি, পোল্ট্রি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের ২০০৮ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কৃষি খাতে নিয়োজিত পুরুষের চেয়ে নারীর অবদান শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ বেশি। এছাড়া কর্মক্ষম নারীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োজিত আছে কৃষিকাজে।
গ্রামীণ ক্ষুদ্র এবং কুটিরশিল্প পুরোপুরি নারীর ওপর নির্ভরশীল। কৃষি খাতেও বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ। একটি বাড়ি একটি খামার এবং ক্ষুদ্রঋণের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নও অনেক বেড়েছে। এরপরও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। গ্রামে কুসংস্কার এবং সামাজিক বাধা প্রকট হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে নারীর আরও অনেক বেশি অবদান রাখার সুযোগ থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। আবার নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়লেও অনানুষ্ঠানিক খাতে মজুরি বৈষম্য এখনো প্রকট।
ফসল লাগানো এবং কেটে ঘরে তুলে আনা ছাড়া কৃষি খাতের সব কাজই নারীরা করে থাকেন। ফসলের প্রাক-বপণ প্রক্রিয়ার শুরু বীজ সংরক্ষণ এবং পরে আবার ফসল উত্তোলনের পর সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণেও নারীরাই মুখ্য ভূমিকা রাখছেন। বলা চলে কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে নারী। তবে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে নারীর এ ভূমিকার স্বীকৃতি নেই বললেই চলে।
গ্রামীণ সমাজে কৃষিকাজকে নারীর প্রাত্যহিক কাজের অংশ বলে বিবেচনা করা হয়। এ কারণেই নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও কমছে না মজুরি বৈষম্য। আজকাল ফসল লাগানো এবং কেটে ঘরে তোলার ক্ষেত্রেও নারীকে কাজ করতে দেখা যায়। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর মজুরি তো দূরের কথা, এই কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিও অবান্তর বলে ভাবা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজের পরিবারের বাইরে গিয়ে মজুরির বিনিময়েও কৃষিখাতে যুক্ত হচ্ছেন নারীরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরুষ শ্রমিকের সমান কাজ করলেও কৃষিখাতে নারী শ্রমিকের বৈধ পরিচিতি নেই, তারা মজুরিও পান পুরুষের অর্ধেক প্রায়।
দেশে নারীর বঞ্চিত হওয়ার কাহিনী বহু পুরনো। নারী অধিকার রক্ষায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। নানা কৌশলে প্রতিনিয়ত ঠকানো হচ্ছে তাদের। গ্রামীণ নারীরা রান্নাবান্না, সন্তান লালন পালন এবং পরিবারের অন্যসব কাজ করার পরও কৃষিকাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মহিলা পরিষদ গ্রামীণ নারীদের নিয়ে গবেষণা করে দেখেছে, গ্রামীণ নারীরা সর্বক্ষেত্রেই অধিকার বঞ্চিত। আবার নারীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনও নন। দেশের গ্রামীণ নারী শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এবং কৃষি তথ্য পৌঁছে দেওয়ার বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের দেশের জাতীয় অর্থনীতির চাকাকে আরও গতিশীল করতে হলে দেশের নারী সমাজকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে মজুরি বৈষম্য তা দূর করে তাদের কাজের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। কৃষিকাজের পাশাপাশি আরও অন্যান্য কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের নারী সমাজকে বাদ দিয়ে দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান