স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান : বঙ্গবন্ধুর অনন্য এক ভাষণ
ড. অনুপম সেন
লেখক: শিক্ষাবিদ ও উপদেষ্টাম-লীর সদস্য, আওয়ামী লীগ
তিন. বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের ব্যাখ্যাও সাধারণ ব্যাখ্যা নয়। তিনি গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা করেছেন এই বলে, ‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্রÑ সেই গণতন্ত্র যা সাধারণ মানুষের কল্যাণসাধন করে থাকে’ (ওই ভাষণ)। আজ ধনতান্ত্রিক বিশ্বে যে গণতন্ত্র প্রচলিত রয়েছে তা হলোÑ বুর্জোয়া গণতন্ত্র। ইংল্যান্ডের ১৬৪৪ এবং ১৬৮৮ সালের বিপ্লব, ফ্রান্সের ১৭৮৯ সালের বিপ্লব এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে ১৮৪৮ সালের বিপ্লবগুলো ছিল মুখ্যত, সামন্ততন্ত্র ও স্বৈরাচারী রাজন্যবর্গের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এইসব বিপ্লবের মাধ্যমে সব মানুষের আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকার পেয়েছিল, অর্থাৎ রাষ্ট্রের কাছে আইনত সবাই সমান। কিন্তু আজ কে না জানে, আইনের দৃষ্টিতে সমান হলেও একজন দরিদ্র ও একজন ধনী কোনোদিনই রাষ্ট্র থেকে সমান মর্যাদা পায় না। আমাদের মতো দেশে প্রতিদিন বিচারের বাণী কীভাবে নীরবে-নিভৃতে কাঁদে তা কি বলার অপেক্ষা রাখে? সাধারণ মানুষ বিত্ত ও ক্ষমতার কাছে প্রতিদিন যে অসংখ্য পরাজয় মেনে নিচ্ছে, তাদের ম্লান মুখে শত শতাব্দীর যে বেদনা তা কি আমরা প্রতিনিয়ত দেখি না? সাধারণ বাঙালির এই বেদনা বঙ্গবন্ধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন বলেই বলেছেন, ‘মানুষের একটা ধারণা আছে এবং আগেও আমরা দেখেছি যে, গণতন্ত্র যেসব দেশে চলেছে, দেখা যায় সেসব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের প্রটেকশন দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে প্রয়োজন হয় শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্রের ব্যবহার। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা চাই, শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলোÑ আমরা দেশের যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে তাতে সেসব বন্দোবস্ত করা হয়েছে যাতে এদেশের দুঃখী মানুষ রক্ষা পায়, শোষকেরা যাতে রক্ষা পায় তার ব্যবস্থা নেই। …কিন্তু যে চক্র দিয়ে মানুষকে শোষণ করা হয়, সেই চক্রকে আমরা জনগণের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করতে চাই। তার জন্য আমরা প্রথমেই ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, কাপড়ের কল, পাটকল, চিনির কারখানা সবকিছু জাতীয়করণ করে ফেলেছি, তার মানে হলো, শোষকগোষ্ঠী যাতে এই গণতন্ত্র ব্যবহার করতে না পারে।’ (ওই ভাষণ)
বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রের রূপ কী হবে, কোনো সমাজতন্ত্রের কথা তিনি বলছেন তাও ব্যাখ্যা করেছেন অনন্য দক্ষতায়, ‘আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং বিশ্বাস করি বলেই আমরা (উপরে উল্লিখিত) জাতীয়করণ করেছি। যারা বলে থাকেন, সমাজতন্ত্র হলো না, সমাজতন্ত্র হলো, তাদের আগে বোঝা উচিত, সমাজতন্ত্র কি? সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েত রাশিয়ায় পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেল, অথচ এখনো তারা সমাজতন্ত্রের পথ এগিয়ে চলেছে। …সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুর। সেই বন্ধুর পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌঁছা যায়। …আমাদের সমাজতন্ত্রের মানে শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। এক এক দেশ এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। …সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেই দেশের কি আবহাওয়া, কি ধরনের অবস্থা, কি ধরনের মনোভাব, কি ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে ক্রমশ এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে। রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করেনি। …নিজ দেশের পরিবেশ নিয়ে, নিজ জাতির পটভূমি নিয়ে সমাজতন্ত্রের অন্য পথে চলেছে। …সেজন্য দেশের পরিবেশ, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের রীতিনীতি, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সবকিছু দেখে ক্রমশ এগিয়ে যেতে হয়। একদিনে সমাজতন্ত্র হয় না’ (ওই ভাষণ)।
বঙ্গবন্ধু গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বুঝেছিলেন অন্যান্য সমাজবিন্যাসের মতো সমাজতন্ত্রও নানা পতন অভ্যুদ্বয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে; এর পথ মসৃণ নয়, বন্ধুর। মনে রাখা উচিত, কোনো সমাজবিন্যাসই একদিনে পরিপূর্ণতা পায়নি। ধনতন্ত্রের পরিপূর্ণতা পেতে সাতশ বছর লেগেছে, দ্বাদশ শতক থেকে ঊনবিংশ শতক। দেশে দেশে ধনতন্ত্রের ভিন্নভিন্নভাবে বিকাশ হয়েছে। ইংল্যান্ডে যেভাবে বিকশিত হয়েছে; জার্মানি বা ফ্রান্সে সেভাবে হয়নি। দীর্ঘ-সংগ্রামে, সাতশ বছরের সংগ্রামে ধনতন্ত্র কিছুটা এগিয়ে যাবার পর আবার পিছু হটেছে, সামন্তরা কিছুদিনের জন্য হলেও কোনো কোনো দেশে জয়ী হয়েছে। সমাজতন্ত্রও সেভাবে এগোবে। দেশে দেশে দৈশিক অবস্থাভেদে এর রূপ হবে ভিন্ন। কিন্তু এক জায়গায় এর এক মৌলিক লক্ষ্য থাকবে, তা হলোÑ শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, যা বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পর জাপানি-আমেরিকান ঐতিহাসিক ফুকায়মা বিশ্বব্যাপী ধনতন্ত্রের সার্বিক জয়ে ইতিহাসের পরিসমাপ্তি হয়েছে, ঘোষণা করেছিলেন। এর ঠিক অব্যবহিত পরেই জাপানে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অভূতপূর্ব বিরাট অর্থনৈতিক মন্দা বা ধস নামে। এই ধসের এক দশক অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই ২০০৮ ও ২০০৯-এ মুখ্যত উন্নত বিশ্বে ধনতন্ত্রের মূলকেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ জুড়ে যে প্রচ- অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিল তা কি ১৯৩০-এর মহামন্দার পরে আবার ধনতন্ত্রের ভিতেই বিরাট ফাটল বা কাঁপুনি সৃষ্টি করেনি? অর্থনৈতিক ধস থেকে যে দুটি বড় দেশ অক্ষত থেকে তাদের অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে তারা হলোÑ চীন ও ভারত। এই দুটি দেশই সমাজতন্ত্রকে কাম্য সমাজব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করে তাদের ব্যাংক ও শিল্পপুঁজির বৃহৎ খাতগুলোকে রাষ্ট্রখাতে রেখেছে। ফলে লগ্নিপুঁজির লাগামহারা লোভের করালগ্রাস তাদের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করতে পারেনি। গত দুদশক ধরে ধনতন্ত্রের যে অব্যাহত অবক্ষয় চলছে তার ফলে সমাজতন্ত্রই কী আবার সাধারণ শোষিত মানুষের সামনে বাঁচার পথ হিসেবে নতুন আলোকে উদ্ভাসিত হচ্ছে না? লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, চিলি, বলিভিয়া ইত্যাদি দেশ সমাজতন্ত্রের পথেই হাঁটছে তাকে যতটুকু সম্ভব দেশভিত্তিক ও যুগোপযোগী করে। (চলবে-২)
সম্পাদনা: আশিক রহমান