‘ঘৃণা’র উল্টো পিঠেই ‘ভালোবাসা’
কাকন রেজা
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
‘অনেকদিন থেকেই শখ ভালো জাতের ‘কুত্তা’ পোষার। বিদেশি না দেশি জাতের। দেশি জাতেরগুলো নাকি ‘মালিক’ভক্ত হয় বেশি।’ কলিগ এবং প্রিয় এক বন্ধুর এমন উক্তিতে ‘বিচলিত’ হলাম আশেপাশের কেউ শুনল কি না। যদিও কথা হচ্ছিল ফোনে, তবু ‘দেয়ালেরও তো কান আছে’। এখন তো কথা বলতে নানা ফ্যাসাদ। ‘গোপাল’ বললেও আঁতে লাগে, মামলা পর্যন্ত হয়। ‘কুত্তা’ নিয়ে আলোচনায় আবার কার কিসে লাগে তা তো বলা মুশকিল! এমন মুশকিল যে ‘মুশকিল আছান’ ফকির পাওয়াও দুষ্কর।
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বামদলের ‘দুর্বল’ হরতালে ‘কুত্তা’ বিষয়ক একটি ছবি নিউজফিড সরগরম করে তুলেছিল। অনেকে বিষয়টিকে ঘৃণা ছড়ানো এবং যারা এ বিষয়ে লিখেছেন তাদেরকে ‘হেটার’ হিসেবে ব্যাখ্যা ও আখ্যা দিয়েছেন। আমিও লিখেছিলাম ‘কুত্তা’ বিষয়ক ছবিটি নিয়ে। অবশ্য আমি ‘ঘৃণা’ ছড়ানোর কাজটি করিনি। আমি শুধু ছবিটি বিষয়ে দুইপক্ষের যুক্তির কল্পিত বিশ্লেষণ করেছিলাম এবং সেটা কোনো পক্ষে না গিয়েই। বলেছিলাম, যারা বলেছেন হরতালকারীদের পক্ষে মানুষ নেই, তাদের যুক্তিও ঠিক। মানুষ থাকলে ‘কুত্তা’ আইবো ক্যান! আবার আরেকপক্ষ বললেন, ‘ন্যায়-অন্যায় পশুও বোঝে’। আমি কইলাম, হেইডাও ঠিক, মানুষই বোঝে না, বুঝলে তো!
কোনো পক্ষে না যাবার কারণ হলোÑ আমি জানি ‘ঘৃণা’র উল্টা পিঠেই থাকে ‘ভালোবাসা’। ‘আমি অখন যারে ‘ঘৃণা’ করুম, হে তো পরক্ষণেই ‘ভালোবাসা’র জিনিস হইব, মধ্যে থিইকা আমি হমু ‘আমের আটি’। হেইডা বুইঝাই আমি কোনো পক্ষে নাই।’ এটা আমার কথা নয়, আমার সেই কলিগের কথা। বলছিলেন নববিবাহিতদের ঝগড়া প্রসঙ্গে। এদের রাগ ভালোবাসা বুঝে ওঠা মুশকিল। এই রাগ, এই ভালোবাসা। আমাদের সকল ঝগড়াই ইদানিং কেন জানি নববিবাহিতদের ঝগড়াটে রূপ নিয়েছে। কে কখন কাকে ‘ঘৃণা’ করছে আবার কখন কাকে ‘ভালোবাস’ছে বোঝা মুশকিল।
বাংলাদেশে হঠাৎ উত্থান ‘হেফাজতে’র। যে হেফাজতের প্রতি ছিল প্রচ- বিদ্বেষ তাদেরই কারও কারও কর্মকা-ে এখন দেখি হেফজত প্রীতি। হেফাজতের পক্ষেও বলা হয়, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই’। সুতরাং যারা হেফাজত বিষয়ে তুমুল বিরোধিতায় নেমেছিলেন এবং যারা হেফাজত প্রশ্নে প্রবল পক্ষপাতিত্বে ছিলেন তাদের সময় এসেছে বিষয়টির গভীরে যাবার। ‘ঘৃণার উল্টো পিঠেই ‘ভালোবাসা’ এমন কথাটি অবশ্যই তাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন।
হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে মূর্তি স্থাপন নিয়ে অনেক কথা। একদল বলছেন, মূর্তি আর ভাস্কর্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। যারা এসবে অবুঝ তারা সভ্যতা সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখেন না। আর্ট-কালচার সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞানগম্যি নেই। তারা এখনো রয়েছে মধ্যযুগে। আরেক দলের কথা, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশে, হাইকোর্ট থেকে মূর্তি অপসারণ করতে হবে। মূর্তিপূজা ইসলামে হারাম। তাই গ্রীক দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা ইসলামের খেলাপ। ন্যায়বিচারের মালিক আল্লাহ তায়ালা, এখানে মূর্তির কোনো স্থান নেই।
মিনমিনে একদল বলছেন, কোনো সময়ই তো হাইকোর্টে মূর্তি স্থাপনের প্রচেষ্টা হয়নি। এখন মূর্তি স্থাপন করে নতুন করে বিতর্ক আর অস্থিরতার জন্ম দেওয়ার প্রয়োজনই কী ছিল! কিছু লোক ব্যাখ্যা করছেন, আইনের দেবীকে শাড়ি পরানো হলো কেন, গ্রীক পুরাণের দেবী কি শাড়ি পরে? এখানে শাড়ি পরিয়ে আইনের দেবীর ভাস্কর্যের মূল ‘থিম’টাকে নষ্ট করা হয়েছে।
এমনসব কথামালার কোন মালাটি আমাদের মতো আমজনতা গলায় পরবে? দ্বিধাদ্বন্দ্বে আর ভালোমন্দে মাথার তার ছিড়ে স্প্রিং হয়ে যাবার দশা। এর মধ্যেও তৃতীয় ও চতুর্থ দলের বক্তব্যে মনে হচ্ছে তারা ‘ঘৃণা’কে ‘ভালোবাসা’য় পাল্টে দেবার চেষ্টায় আছেন। সুতরাং যেকোনো সময় ‘ঘৃণা’ পরিণত হতে পারে ‘ভালোবাসা’য়। অতএব ‘মালা হইতে সাবধান’ ইহা জলাতঙ্কে’র কারণ না হইলেও ‘জ্বালা’ কিংবা ‘আতঙ্কে’র কারণ হইতে পারে।
পাল্টে দেওয়া, পাল্টে যাওয়া আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। আবার হরতাল প্রসঙ্গে আসি। হরতাল দেওয়া হলো গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে। একইদিন ‘খান’ সাহেব ডাকলেন ‘ধর্মঘট’। খান সাহেবের বাহিনী মাঠে নেমে পড়ল, ‘চাক্কা বনধ’। খবরের কাগজের পাতা থেকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ উধাও। শুরু হলো ‘খান’ বন্দনা কিংবা নিন্দা। আগেই বলেছি, ‘ঘৃণা’র উল্টো পিঠেই থাকে ‘ভালোবাসা’। সুতরাং সে অর্থেই ‘খান’ সাহেবের ‘নিন্দা’কেও ‘বন্দনা’ বললে দোষ কী, প্রক্রিয়া তো একটাই! ‘খান’ সাহেবের বদৌলতে ‘হরতাল’ বদলে গেল ‘ধর্মঘটে’! গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ পিষে গেল ‘চাক্কা বনধ’-এর চাপায়! আমজনতার তারছিড়া অবস্থা ‘ঘৃণা’ ‘ভালোবাসা’র এমন পিষাপিষিতে। সঙ্গে গ্যাসের চুলা, আর গাড়ির ভাড়া বৃদ্ধির চিন্তায়।
আমার সেই কলিগ, দিনে রাতে আমেরিকার নয়া প্রেসিডেন্টকে বকাবাজি করেন। ‘ট্রাম্প’ ভায়ার দোষ তিনি সাংবাদিকদের অসৎ আখ্যা দেন, সঙ্গে নানা ব্যাখ্যা দেন, গালিগালাজও বাদ যায় না। আজ দেখি তিনিই বলছেন, ‘ট্রাম্পই ঠিক’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেককেই দেখলাম, একই আওয়াজ তুলতে, ‘ট্রাম্পই ঠিক’। বললাম, দেখলে ভায়া, ‘ঘৃণা’র উল্টো পিঠেই থাকে ‘ভালোবাসা’। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় কা-ে তোমাদের ‘ঘৃণা’ পরিণত হয়েছে ‘ভালোবাসা’য়। তবে একটু দেরিতে হয়েছে। এর আগেও খবরের কাগজ ও মাধ্যমগুলো ‘নর্থ’ কে ‘সাউথ’ বানিয়েছে তখন তোমরা চুপ থেকেছ, যেহেতু সেটা ছিল তোমাদের গোষ্ঠী স্বার্থে। আর এখন যেটা বলছ সেটাও তোমার ও তোমাদের গোষ্ঠী স্বার্থে।
কলিগ তো খেপে ভূত। একটি কাগজের নামের ‘ক’ তুলে ‘ব’ বসিয়ে যে ‘ট্রল’ করা হয়েছে, সেই শব্দ উল্লেখ করে কলিগ বলল, তুমি আমার ‘অইটা’ জানো। আমি হাসতে হাসতে বললাম, এখন সবাই ‘অইটাই’ জানে এবং মানে। তুমিও মানবে, যখন দেখবে তোমার ‘সেলারি’ ‘ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসামে’র চাইতেও ‘হ্যান্ডসাম’ হয়েছে। তখন তোমার কাছেও সবকিছু ‘বসুন্ধরা’র কাগজের মতো ‘ফকফকে’ দেখাবে। ওপারের কথা শুনে মনে হলো, ফোনটি আইফোন সিক্স না হলে হয়তো এতক্ষণে গুড়ো হয়ে যেত। তার ফোন কাটার ধরণে হাসলাম এবং ভালোবাসলাম। কারণ আমি জানি, ‘ঘৃণা’র উল্টো পিঠেই থাকে ‘ভালোবাসা’। ‘রাগে’র উল্টো পিঠে ‘অনুরাগ’। কী বলেন?
সম্পাদনা: আশিক রহমান