আগুনশব্দে মুখর ছিল দিনটি
উম্মুল ওয়ারা সুইটি
লেখক: সাংবাদিক, গল্পকার ও সংস্কৃতিকর্মী
পরনে ছিল দুধসাদা পাঞ্জাবি। তার ওপর হাতাকাটা কালো কোট। দৃঢ়তার সঙ্গে মঞ্চে উঠলেন দীর্ঘদেহী এক বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সামনে জনসমুদ্র। দরাজ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন কালজয়ী সেই ভাষণ। সে ভাষণ শুধু বাঙালির স্বাধীনতার ঘোষণাই ছিল না, ছিল এক অনবদ্য কাব্য। সেই থেকে ৭ মার্চ আমাদের হয়ে রইল। কিন্তু কেমন ছিল দিনটি; যাকে ঘিরে এত উপাখ্যান, এত বীরত্ব, কেমন কেটেছিল সেদিন বাঙালির সেই অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর; কেমন প্রস্তুতি ছিল তার ভাষণের আগে; বিভিন্ন সময় প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে ও সংগৃহীত ইতিহাস থেকে জানা গেছে সেসব অনেক অজানা কথা। দলীয় নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক; সেদিন ৭ মার্চ ভাষণের আগে কি করলেন বঙ্গবন্ধুÑ এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর জামাতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার স্মৃতিকথায় লেখেন, ‘ওইদিন বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনের লাইব্রেরি কক্ষে তাজউদ্দিন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ড. কামাল হোসেনসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অংশ নেন।
ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু সবাইকে বলেন, ছাত্রজনতার দাবির সঙ্গে তার একমত পোষণ করেছেন এবং বিকেলে রেসকোর্সে চার দফার দাবি পেশ করা হবে। এরপর ড. কামাল হোসেনকে চার দফার খসড়া তৈরি করতে বলেন। দুপুরের খাবারের পর তিনি বিশ্রাম নেওয়ার সময় তাকে চূড়ান্ত কপিটি দেখানো হয়। কপিটি টাইপ করেছিলেন মোহাম্মদ হানিফ। এ সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে টাইপ কপির সঙ্গে যেন মূল কপিটি মিলিয়ে দেখার নির্দেশ দেন।’ কী ছিল সেই চার দফাÑ ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’; কিংবা ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’Ñ এমনতর যেসব আগুনশব্দ সেদিন আগুন জ্বালিয়েছিল মুক্তিকামী মানুষের মনে; অথচ সেদিন ভাষণের জন্য তৈরি ঘোষণাপত্রে এসব শব্দ বা বাক্যের কিছুই ছিল না। বুকের ভিতর থেকে উৎসারিত এসব শব্দ বা বাক্য এসেছিল মুক্তিকামী বাঙালির যন্ত্রণা লাঘবে মুক্তির নির্দেশিকা হিসেবে। ঘোষণাপত্র প্রসঙ্গটি বিস্তারিত উঠে এসেছে এম এ ওয়াজেদ আলীর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থেÑ ‘সেদিন ৭ মার্চে ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত কপিটি মিলিয়ে দেখার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু খন্দকার মোশতাককে জিজ্ঞেস করেন, ‘ইশতেহারে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে কি না’। তিনি বলেন, ‘সামরিক শাসনের ক্ষমতাবলে জারিকৃত আইনগত কাঠামোর অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় বসে পাকিস্তানের অখ-তা লঙ্ঘন সংক্রান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার ব্যাপারটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং, এই ব্যাপারটা ইশতেহারে লেখা হয়নি।’
সেদিনের ইশতেহারে ইয়াহিয়া খানের কাছে চার দফা দাবি করা হয়। দাবিগুলো হলোÑ ১. সামরিকবাহিনীর সমস্ত লোককে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। ২. পহেলা মার্চ হতে আন্দোলনে যে সমস্ত ভাইবোনকে হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে তদন্ত করে সে ব্যাপারে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। ৩. সামরিক আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নিতে হবে। ৪. অবিলম্বে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দলের নেতার কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। রেসকোর্সের পথেÑ রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) রওনা হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু কয়েকজন নেতাকর্মীকে ডেকে বলেন, ‘চার দফার এই ইশতেহারটি দেশি ও বিদেশি সাংবাদিকদের মাঝে বিলি করবে।’ এই বলে তিনি একটি ট্রাকে উঠে যাত্রা করেন। সে সময় সে ট্রাকে ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, শেখ ফজলুল হক মণি, ছাত্রলীগের প্রাক্তন সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, সিরাজুল আলম খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। আর মোস্তফা মহসীন মন্টু, কামরুল আলম খসরু, মহিউদ্দিন, আ স ম আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজসহ অন্যান্য নেতাকর্মীরা ছিলেন অন্য একটি ট্রাকে।
হঠাৎ করে বন্ধ হয় ভাষণ সম্প্রচার; সেদিন রেসকোর্সে নৌকা আকৃতির সভামঞ্চটি স্থাপন করা হয়েছিল বর্তমান শিশুপার্কের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে। বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে যাওয়ার পর একটি গাড়ি নিয়ে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের সঙ্গে যাত্রা করেন ওয়াজেদ মিয়া। মঞ্চের কাছাকাছি পৌঁছে শেখ হাসিনা রেডিও চালু করতে বলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচারের কথা এ সময় রেডিওতে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছিল। কিন্তু ভাষণ শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই রেডিও নিস্তব্ধ। সম্প্রচারের অনুমতি থাকার পরও সরকারের তাৎক্ষণিক নির্দেশে ভাষণ সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেদিন রাতে ইকবাল বাহার চৌধুরীর নেতৃত্বে রেডিও পাকিস্তান কেন্দ্রের সকল কর্মকর্তা ৩২ নম্বরের বাসায় এসে বঙ্গবন্ধুকে জানান যে, এ ভাষণ সম্প্রচার করতে না দেওয়া পর্যন্ত তারা কাজে যোগ দেবেন না। এদিন রেডিও পাকিস্তানের সব অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল। ৮ মার্চ সকাল ৮টায় পাকিস্তান রেডিও ঢাকা কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয় যে, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ হুবহু সকাল ৯টায় প্রচার করা হবে।
আজ থেকে প্রতিদিন দুবেলা আমার সঙ্গে খাবে; সেদিন ভাষণ শেষে বঙ্গবন্ধু রাতে পুরো পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে রাতের খাবার খেতে বসেন। এ সময় বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া, শেখ কামাল, শেখ জামাল, রেহানা, রাসেল ও শেখ শহীদ উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু এ সময় গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আমার যা বলার ছিল আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যেকোনো মুহূর্তে গ্রেফতার করতে পারে। সেজন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দুবেলা আমার সঙ্গে খাবে।’ সেদিন থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবার তার সঙ্গে খেয়েছেন। (তথ্যসূত্র: ‘বঙ্গবন্ধু কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন’Ñ মুনতাসীর মামুন)
সম্পাদনা: আশিক রহমান