‘আই অ্যাম অলওয়েজ রেডি অন কল অ্যাট ইওর সার্ভিস’
প্রতীক ইজাজ
ঘর থেকে বাহির, দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বÑ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সেই ৭ মার্চের ভাষণ এখন সর্বব্যাপী আলোচিত। গবেষণা হচ্ছে। ভাষণের বাণী, গতিময়তা, তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠ; শুধু বাঙালির মুক্তি আন্দোলনই নয়, নানাভাবে প্রেরণা জুগিয়েছে বিশ্বের প্রগতিশীল আন্দোলনে, মুক্তির সংগ্রামেও। বাঙালি ও বাংলা ভাষার সীমানা ছাড়িয়ে সে ভাষণ তাই একদিন স্থান করে নেয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। জায়গা করে নেয় পৃথিবীর সেরা ভাষণগুলোর মধ্যে।
আমি যতবারই সেই ভাষণের কথা ভেবেছি, শুনেছি, দেখেছিÑ ভেসে উঠেছে অনেক ছবি, দৃশ্যের পর দৃশ্য। বিশেষ করে ‘কলরেডি’র সেই মাইক্রোফোন বারবার কথা বলে ওঠে আমার কাছে। খুব জানতে ইচ্ছে করেÑ কিভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধুর সেই আগুনঝরা ভাষণ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তারা। কেমন ছিল সেদিন, আর কীভাবেই বা দায়িত্ব পালন করল ‘কলরেডি’- এসব জানতে অনেকবার কথা হয়েছে কলরেডির পরিচালক সাগর ঘোষের সঙ্গে। সর্বশেষ কথা হয় গতবছর ৭ মার্চের আগেও। সাগর ঘোষ থাকেন পুরনো ঢাকার লক্ষীবাজারে। কথা হলো সেখানেই। জানালেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির আদি মালিকদের মধ্যে একজন আমার পিতৃব্য কানাই ঘোষ। ১৯৭১ সালে তার (কানাই ঘোষ) বয়স ছিল ১৭-১৮ বছর। ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচারিত হয়েছিল তার লাগানো মাইকেই। জনসভার একদিন আগে থেকেই কানাই ঘোষ তার অন্য দুই ভাইকে নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে মাইক লাগিয়েছিলেন।
‘কানাই ঘোষ নেই। তার অন্য দুই ভাই দয়াল ঘোষ ও হরিপদ ঘোষও প্রয়াত হয়েছেন। এর মধ্যে এক ভাই দয়াল ঘোষ, অর্থাৎ সাগর ঘোষের বাবা প্রয়াত হন ২০০৪ সালে। পরে পারিবারিক সূত্রে তার চার ছেলে হাল ধরেন ব্যবসার। তাদেরই একজন সাগর ঘোষ। তাকে সহায়তা করছেন চাচা কানাই ঘোষ ও অপর দুই ভাই বিশ্বনাথ ঘোষ ও শিব নাথ ঘোষ। সময় পরম্পরায় হাত বদল হলেও কেবল বদলায়নি সেই স্থান। ইতিহাসের নির্বাক রাজসাক্ষী কলরেডির দোকান লক্ষীবাজারের সেই একই স্থানেÑ ৩৬, এইচ কে দাস রোড, লক্ষীবাজার, সূত্রাপুরে। বললেন, ‘৭ মার্চ অনেক ঝুঁকি সত্ত্বেও কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে মাইক লাগিয়েছেন কানাই ঘোষ। এক প্রকার হাতে প্রাণ নিয়ে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ শুরু করেন তখন তিনি কাছেই ছিলেন।’
‘তখন সারা দেশই টানটান উত্তেজনায়। সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছেন কখন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেবেন। সভা আয়োজনও নাকি শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু মাইকের ব্যবস্থা করা যাচ্ছিল না। তখন সমাবেশের মাইক সরবরাহের প্রস্তাব দেওয়া হলো আমাদের। আমরা পাকিস্তানিদের রোষানলের ঝুঁকি নিয়ে মাইক সরবরাহ করলাম। জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় অনেকেই নিষেধ করছিল। কিন্তু তবুও আমরা মাইক সরবরাহ করি।’ ‘ওইদিন জনসভায় রেসকোর্স ময়দানে ব্যবহৃত মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ডটি আজও সংরক্ষিত আছে আমাদের কাছে। সেদিন যেসব অ্যামপ্লিফায়ার ব্যবহার করা হয়েছিল তার মধ্যে সাতটি অ্যামপ্লিফায়ার এখনো আছে। আছে চারটি মাইক্রোফোন।’ ‘কিন্ত’- বলে কিছুক্ষণ থামলেন সাগর ঘোষ। তারপর বললেন, ‘আর পারছি না। ব্যবসার মন্দা দশা। সরকারের উচিত যন্ত্রগুলো সংরক্ষণ করা।’
কথায় কথায় জানালেন, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের সব সভা-সমাবেশে উপস্থিতি ছিল কলরেডির। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু সাউন্ড সার্ভিস কোম্পানি হিসেবে। তখন নাম ছিল আরজা (আরজেএ) ইলেক্ট্রনিক্স। এ নাম বদলে রাখা হয় কলরেডি অ্যাট সার্ভিস। পূর্ণরূপ হচ্ছে ‘আই অ্যাম অলওয়েজ রেডি অন কল অ্যাট ইওর সার্ভিস’। ’ ‘একবার মনের কষ্টে এসব সরঞ্জামাদি বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিলেন কানাই ঘোষ ও তার উত্তরাধিকাররা’Ñ বললেন সাগর ঘোষ। কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘স্বীকৃতির অভাবে’। ‘এসব সরঞ্জামাদি ও ঐতিহাসিক ঘটনা লিখে ২০১০ সালে ওয়েবাসাইট তৈরি করা হয়েছিল কলরেডি নামে। বর্তমানে আর্থিক সমস্যার কারণে মাইকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীর সংখ্যাও কমিয়ে ফেলতে হয়েছে। কমে গেছে ব্যবসার পরিসর। তাই ব্যবসা বাঁচাতে ও কাজের স্বীকৃতি দানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
সাগর ঘোষ মনে করেন, ‘কলরেডির আরেক নাম বাংলাদেশ; যাতে গর্জে উঠে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক। এই কলরেডি একদিনে এ অবস্থায় আসেনি, এর পেছনে রয়েছে বহু সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা।’ কিন্তু ক্ষোভও রয়েছে। বললেন, ‘সারা বিশ্বের মানুষ বঙ্গবন্ধুর সেই কালজয়ী ভাষণ শুনতে পেরেছে যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, তাকে আজ পর্যন্ত কোনো প্রকার সম্মাননা দেওয়া হয়নি। বরং পুঁজির অভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হতে বসেছে।’ জানি, টাকা দিয়ে কলরেডির সেই দিনের কাজকে মূল্যায়ন করা যাবে না। সম্ভব নয়। দরকার স্বীকৃতি। কলরেডি কেবল একটি মাইক সার্ভিস নয়; ইতিহাস, আলোকবর্তিকা। কলরেডি মানেই বঙ্গবন্ধুর মুখ।
লেখক: সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান