বাংলাদেশের কবিতা ও রাজনৈতিক চেতনায় ৭ মার্চ
মিল্টন বিশ্বাস
পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই মোহভঙ্গের ফলে ঢাকা নগরকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত প্রথম প্রতিবাদ করল ১৯৪৮-এর মার্চ মাসে ভাষার প্রশ্নে। অন্যদিকে ১৯৪৭-১৯৫১ সময় প্রবাহে পাকিস্তান শাসিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ঘটে একাধিক ঘটনা। বিভাগোত্তরকালে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার ভিত্তিতে বহুসংখ্যক মুসলিম বাস্তুচ্যুত পরিবারের পূর্বাঞ্চলে আগমন এবং পরবর্তী সময়ের প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনজীবনকে করে তোলে দুর্বিষহ। জনগণ মৌলিক চাহিদাগুলো থেকে বঞ্চিত হয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সরকারের ভ্রান্ত খাদ্যনীতি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাঙালির জন্য রীতিমতো অত্যাচারের ভয়াল রূপ হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। ১৯৪৮ সালের মার্চের ভাষা প্রশ্নে প্রতিবাদের পথ বেয়ে ১৯৪৯-এ জন্ম হয় ‘আওয়ামী মুসলিম লীগে’র। এই রাজনৈতিক সংগঠনটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান অনুঘটক। অন্যদিকে বিভাগোত্তর কালের কমিউনিস্ট পার্টির একমাত্র প্রগতিশীল সাহিত্য সংগঠন ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’ ক্রমশই কমিউনিস্ট বিপ্লবের দ্বিধাবিভক্ত ও তাত্ত্বিক বিতর্কের ফলে ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা জেলায় এর অস্তিত্ব একেবারে বিলুপ্ত হয়।
কেন্দ্রীয় সরকারের অবদমন নীতি ও বাংলাদেশকে পাকিস্তানের নতুন-কলোনিতে পরিণত করার চক্রান্তে এবং রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে যে গভীর ষড়যন্ত্র ও বিতর্ক উত্থাপিত হয়, এরই ফলে সংগঠিত হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ এই কালক্রমিক ঘটনাপ্রবাহে পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তদান ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের জানান দেওয়ার ঘটনা। দেশ-বিভাগোত্তর কেন্দ্রীয় প্রশাসনের রাজনৈতিক কূটজাল, অত্যাচার, নিপীড়ন, ধর্মীয় কলহ ও দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তারের বিরুদ্ধে বাঙালির ঐক্য ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় লাভ অনিবার্য করে তোলে। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা গঠিত হলেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তে বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতির অবনতি ও বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে দাঙ্গার সৃষ্টি করে ১৯৫৪ সালের মে মাসে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা পরিকল্পিতভাবে বাতিল করা হয়। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসনের বিচিত্রমুখী ষড়যন্ত্রের পরে দেশে সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের ঘটনা ঘটে। সামরিক শাসক দেশের রাজনীতি, সং¯ৃ‹তি, সাহিত্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়।
মূলত দেশবিভাগ থেকে ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী পাঁচ বছর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ দ্বন্দ্ব-জটিল হলেও এর সাংস্কৃতিক পরিম-লটি ছিল সকল বিকৃতি, কুসংস্কার, কূপম-কতা এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও সম্প্রদায়গত সকল প্রকার বৈরীভাবের বিরুদ্ধে মানবতার আদর্শকে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রে মহিমাদীপ্ত করার কাল। এদিক থেকে ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কাগমারিতে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের আন্তর্জাতিক মানের সাংস্কৃতিক সম্মেলনের কথা উল্লেখযোগ্য। রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির এই যোগসূত্র বাংলাদেশের কবিদের আলোড়িত করেছিল স্বাভাবিক কারণে। তবে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সালের সামরিক জান্তার করতলগত বাংলাদেশের নগর-গ্রামের গণ-জাগরণ এ অঞ্চলের সমাজমানসের প্রগতিশীল রূপান্তরের স্বতন্ত্র মাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এরপর স্বাধীকার অর্জনের পথে ১৯৬৯ পথ বেয়ে ১৯৭১-এর মুক্তিসংগ্রাম দেশবিভাগের পরবর্তী আরেকটি দেশবিভাগের ঘটনাকে ত্বরান্বিত করে দেয়। জন্ম হয় নতুন দেশÑ ‘বাংলাদেশ’। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বিভিন্ন কালানুক্রমিক ঘটনাধারায় আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানসে অসাম্প্রদায়িকচেতনা, মানবতাবাদী আদর্শ এবং প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক জীবনবোধের বিকাশ ঘটে। কবিরা সেই শ্রেণির অংশ হিসেবে তাদের কবিতার ধারায় ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মাণ করেন স্বাধীকারের সপক্ষে আমাদের সমাজমানসের বিচিত্র তরঙ্গ। বঙ্গবন্ধু নিজে কবি ছিলেন না কিন্তু ছিলেন রাজনীতির কবিÑ ‘রাজনীতির প্রকৌশলী নন মুজিব, মুজিব হচ্ছেন রাজনীতির কবি, বাঙালির স্বাভাবিক প্রবণতা প্রয়োগিক নয়, শৈল্পিক।
লেখক: অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান