যে দেশে মানুষকে ‘মাল’ হিসেবে গণ্য করা হয়!
ডা. জাকির হোসেন
লিখি অনেকদিন হলো। এবার লিখছি শুধু একটি শব্দ নিয়ে। অনেক পাঠক অবাক হচ্ছেন? হওয়ারই কথা। শৈশব থেকেই কম্বাইন্ড শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে বেড়ে উঠেছি। কম্বাইন্ড শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে পড়াশোনা করে, বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক র্কাযক্রমে সম্বলিতভাবে অংশগ্রহণ করে, দৈনন্দিন আবেগ, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা বিনিময় করে তারা বেড়ে ওঠে। এইভাবে বেড়ে ওঠা শুধু নিছক বেড়ে ওঠাই নয়, এখানে জীবনের সবচেয়ে বড় মূল্যবোধ শিখে ছেলে-মেয়েরা বড় হয়। এই মহা মূল্যবান মূল্যবোধ হলোÑ মানুষকে সর্ব প্রথম মানুষ হিসেবে গণ্য করতে শেখা। নর ও নারী ভিন্ন ভিন্ন জেন্ডার হলেও আমরা সবাই মানুষ।
ঘটনার প্রেক্ষাপট শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে সাম্প্রতিক সময়ে একজন নারী চিকিৎসকের সঙ্গে স্থানীয় এক বখাটের অশোভন আচরণ নিয়ে। নারী চিকিৎসককে ওই বখাটে পাখা চালু করতে বললে নারী চিকিৎসক বলেছিলেন, ‘এই শীতের সময় আপনার পাখার কী…?’ প্রতিউত্তরে ওই বখাটে বলেছিল, ‘আপনার মতো ‘হট মাল’ থাকলে পাখা তো লাগবেই’! তাৎক্ষণিক তার সহপাঠী ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা এই ইভটিজিংয়ের কড়া প্রতিবাদ করেন। এই প্রতিবাদই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। কিছু মিডিয়া একতরফা মিথ্যে প্রচারণা চালায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ইন্টার্নশিপ ছয় মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে। বলেছিলাম, একটি শব্দ নিয়ে লিখব। বোঝার সুবিধার্থে পাঠকদের সামনে ঘটনার প্রেক্ষাপট তুলে আনলাম। এবার আসি আমার মূল লেখায়।
একটি দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন আছেন নারী। জাতীয় সংসদের স্পিকার থেকে শুরু করে আমাদের দেশের অনেক অনেক বড় আসনে আসীন আছেন নারী। কিছুদিন আগেও গণমাধ্যমগুলোতে ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে সরকার জোরাল প্রচারণা চালিয়েছে। দেশের অনেক স্থানে মোবাইলকোর্ট বসিয়ে ইভটিজারদের বিচারের আওয়াতায় আনা হয়েছে। ইলেট্রনিক গণমাধ্যমগুলোতে ইভটিজারদের সামাজিকভাবে প্রতিহত করতে অনুপ্রেরণামূলক অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে। সেই থেকে আমাদের দেশে ইভটিজিং শব্দটা সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই শব্দের ভয়াবহতা কত বেশি হলে রাষ্ট্রের সর্বশক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এই নারী চিকিৎসকের ক্ষেত্রে আমাদের কী দেখতে হলো? তবে কি রাষ্ট্র ক্ষেত্র বিশেষে অপরাধ দমন করছে? আমাদের নারী নেত্রীরা কি ক্ষেত্র বিশেষে নারী আন্দোলন করে রাজপথ উত্তপ্ত করছেন? দেশের এই নারীর চেয়ে অনেক কম মেধাসম্পন্ন কিন্তু চাকরির সমমান পদে অধীন একজন প্রশাসন ক্যাডার কিংবা পুলিশ ক্যাডার একজন নারীর সঙ্গে এই ঘটনার সূত্রপাত হলে কি ওই অপরাধী ছাড় পেত? কিংবা এই নারী চিকিৎসক কোনো রাজনৈতিক নেতার মেয়ে হলে পরিস্থিতি সেদিন কোন পর্যায়ে দাড়াত? তবে কী এই মেধাবী নারী চিকিৎসকের পিতা তার সারাজীবনের শ্রম দিয়ে মেয়েকে চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তুলে ভুল করেছেন? নাকি নারী চিকিৎসক তার মেধাকে সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেননি বলে মানবসেবাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন?
বিচারের বাণী বহু ক্ষেত্রে নীরবে কাঁদে। চোখে দেখার কিংবা হাত বোলানোর কেউ থাকে না। মানুষকে দিব্যি আমরা ‘মাল’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারি, কিংবা বহু ক্ষেত্রে পণ্যের মতো কেনা-বেচা করতে পারি। যখন থেকে মন ও মননকে একটু বিকশিত করতে শিখেছি তখন থেকেই নারী আন্দোলনের বিরোধিতা করতাম। কারণ আমরা সবাই মানুষ। জেন্ডার ভিন্ন হলেও আমাদের পরিচয় তো মানুষই। সবসময় বলতাম, আন্দোলন হোক যারা অপরাধ সংঘটিত করে তাদের বিরুদ্ধে, শক্ত হাতে দমন করা হোক দুর্বৃত্তদের। এখন তাই চাই। আমাদের জেন্ডার নয়, পরিচয় হোক মানুষ। মানবতার, মানবিকতার জয়গান হোক। দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থাই সকলের কাম্য।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান