প্রকৃতি ও মানুষ : শান্তিময় পৃথিবীর সন্ধানে
মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম
মানুষের জন্ম এবং তার শারীরিক গঠনের জন্য দরকারি উপাদান-অণু-পরমাণু সৃষ্টি ইত্যাদি সকল কিছুর উৎস প্রকৃতির দান। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এমনকি মৃত্যুর পর তার দেহাবশেষও প্রকৃতিতেই শক্তি বিবেচ্য হয়ে অন্য শক্তির যোগানে রূপান্তরিত হয়। জীবদ্দশায় তার আহার-বিহার, ভরণ-পোষণ, পোশাক-আশাক সবই প্রকৃতির বদন্যতায় প্রাপ্ত। যে পরিমাণ তার বেঁচে থাকার বিকাশপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য দরকার সে পরিমাণ প্রাপ্তির বা গ্রহণ করার অধিকার প্রদানে প্রকৃতি সদা প্রস্তুত এবং তাতে প্রকৃতির অপরাপর সদস্যদের কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ মানুষ প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ; পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার প্রক্রিয়াটি চলে নিরন্তর স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে। অন্যান্য সকল প্রাণী ও উদ্ভিদকূল মানুষের মতো একইভাবে অভিন্ন প্রাকৃতিক অনুশাসনের অধীন। প্রাণী হিসেবে মানুষ অন্যান্য জীবের মতো বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে নিজে বাঁচার কাজে ব্যবহার করে এবং ঠিক সেই পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড সে বর্জন করে অন্যের প্রয়োজন প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেয়। প্রয়োজনের অধিক গ্রহণ করলে যে পরিমাণ বাড়তি গ্রহণ করল বা কব্জা করল সেই পরিমাণটা হবে অন্যায্য এবং বলৎকারী। জোরপূর্বক করায়ত্ব করার মধ্যদিয়ে গ্রহণ করলে যে পরিমাণ গ্রহণ করল সেই পরিমাণ ক্ষতিসাধিত হবে প্রকৃতির এবং একইসঙ্গে ক্ষতি ডেকে আনা হবে নিজেরও।
কারণ তাতে প্রকৃতির ভারসাম্যে টান পড়বে। প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সেই টান পরিমাণ ভারসাম্যহীনতা মানুষের অস্তিত্বকেও স্পর্শ করবে। অতীতে সুদূর অতীত দিনে অবস্থা ছিল ভিন্নতর। প্রকৃতির অফুরন্ত শক্তি ও সম্পদরাজির মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জমান থাকার মতোই ছিল মানুষের অবস্থা। চাহিদার তুলনায় সম্পদ সম্ভাবনার অর্থাৎ জীবম-লের কার্যপ্রক্রিয়ার আয়তনের সঙ্গে তুলনা করলে সমস্ত আদি সামাজিক-অর্থনৈতিক গঠন ব্যবস্থায় মানবজাতির ক্রিয়াকলাপের আয়তন এতই নগণ্য ছিল যে তা প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর মনুষ্য ক্রিয়াকলাপের বস্তুত উপেক্ষা করার সম্ভাবনা দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান অবস্থা যে সেখানে নেই তার একটি ধারণা পাওয়া যায় বিভিন্ন তথ্যাদি থেকে। সোভিয়েত বিজ্ঞানী আকাদেমিশিয়ান স.স. শভারৎস হিসাব করে বলেছেন, জীবম-লের উপর দুনিয়ার বর্তমান জনসংখ্যার প্রভাবের প্রখরতা ও আয়তন প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর প্রস্তর যুগের ৪০০০ কোটি মানুষের প্রভাবের চেয়েও বেশি। অতীতে বহুকাল ধরে মানুষ স্থানীয় পরিবেশকে প্রভাবিত করে চলছে। তবে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব ব্যাপ্ত হয়েছে। খ্রিস্ট জন্মের ২০ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র এক লক্ষ এবং খ্রিস্ট জন্মের সময় অর্থাৎ আজকের সময় হতে দুই হাজার বছর আগে জনসংখ্যা ছিল বিশ কোটি। ১৯৫০ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচশত কোটিতে। মাত্র ৩৭ বছরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমান। ফলে এতদিন এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন না হলেও আজকের এই বিপদের দিনে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়ার কথা মানুষের। কিন্তু বেঘোরে অবস্থা মানুষের, ভোগে-বিলাসের বুদ হয়ে আছে। ঠিক যেমন মদ-মত্ততায় গোগ্রাসী মাতালের সঙ্গে তুলনা করেছেন কবি নজরুল ইসলাম সিন্ধু নদকে তার সিন্ধু কবিতায়। মানুষ স্বথান্ধতায় আকণ্ঠ ডুবে আছে। মানুষের এরূপ দশায় নিপতিত হওয়ার প্রক্রিয়া পশ্চিমা দর্শন এক অংশ রূপে নয় বরং তাকে তার বাইরে ও তার উপরে প্রভুত্বকারী এক অস্তিত্বরূপে বিবেচনা করার প্রবণতা সাংস্কৃতিতে বিদ্যমান।
মানুষের স্বার্থপরতা সভ্যতার সমার্থক হয়ে অর্থ ও অর্থ সংশ্লিষ্ট কর্মকা- সবকিছুর সঙ্গে এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে যেন পরিণামে অর্থ আর মানুষ একাকার হয়ে পড়েছে অর্থ নামক একটি বস্তুটি মাত্র। অথচ মানুষ এর বাইরে অনেক কিছুর সমন্বিত সত্তার জীব। মানুষ নিজে প্রগতিশীল একটি সংস্কৃতি। দেহ ও মন নিয়ে সদা পরিবর্তনশীল এই সংস্কৃতি। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত, মানুষ বিবর্তন ধারায় শ্রেষ্ঠ জীব। তাই মানুষের মনে নতুন চিন্তা-নতুন বোধোদয় হবে। মানুষ বুঝতে পারবে এই পৃথিবীর মালিক কেবল মানুষ নয়। প্রকৃতির সকল প্রজাতির সমান অধিকার রয়েছে এই পৃথিবী এবং এর সকল সম্পদের উপর। সকলেরই বেঁচে থাকার বিকশিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি জাতি তার ইতিহাস ঐতিহ্যের ভিত্তিতে স্বাধীন ধারায় ভিতর থেকে তার জনগোষ্ঠী, প্রকৃতি, পরিবেশ, যাবতীয় সম্পদ সম্ভাবনা সবকিছুর সামঞ্জস্যপূর্ণ, ন্যায্য বিকাশের মধ্য দিয়ে জেগে ওঠে সমগ্র মানবজাতিকে এক মানবীয় সংস্কৃতির ধারায় জাগিয়ে তুলবে। মানুষ নতুন উদ্যমে, নতুন জীবন বিকাশের ধারায় নতুনভাবে আবিষ্কার করবে এই পৃথিবীকে। নতুন পথের সন্ধান পাবে। নতুন শান্তির পৃথিবীতে মানুষ ও প্রকৃতি পরস্পর হাত ধরাধরি করে অনন্তের যাত্রার অভিযাত্রী হবে।
লেখক: সাবেক এমপি ও আহ্বায়ক, জাগরণী শান্তিসংঘ, বাংলাদেশ
সম্পাদনা: আশিক রহমান