উড়াল সেতুর ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের দায়িত্ব কার?
ইকতেদার আহমেদ
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে যানজট নিরসনে কয়েকটি উড়াল সেতু নির্মাণ করা হয়েছে এবং কয়েকটির নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। তাছাড়া ভবিষ্যতে আরও কয়েকটি উড়াল সেতু নির্মাণের পরিকল্পনার কথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ হতে ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকা শহরে ইতোমধ্যে যে সকল উড়াল সেতুর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়েছে এর কোনোটির বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ ছিল সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ), কোনোটির গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (রাজউক), কোনোটির স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রকৌশল বিভাগ আবার কোনোটির ঢাকা সিটি করপোরেশন।
শহরস্থ উড়াল সেতুসমূহের মধ্যে একমাত্র চাঙ্খারপুল হতে যাত্রাবাড়ির কুতুবখালি অবধি বিস্তৃত মেয়র হানিফ উড়াল সেতুটিতে যানবাহন চলাচলে টোল প্রদান করতে হয়। এ উড়াল সেতুটিতে চলাচলকারী যানসমূহ হতে একটি নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত এটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে টোল আদায়ের অধিকার দেওয়া হয়েছে। এ উড়াল সেতুটির রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সম্পন্ন করে থাকে বিধায় এটির দুপাশে সচরাচর ময়লা-আবর্জনার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় না। অপরাপর উড়াল সেতুসমূহ সরকারি সংস্থার ব্যবস্থাপনায় নির্মাণ পরবর্তী এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ সিটি করপোরেশনের উপর ন্যস্ত হওয়ার কথা থাকলেও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট নির্দেশনার অনুপস্থিতিতে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সমন্বয়হীনতার অভাব প্রতিভাত। এ সকল উড়াল সেতুর কোনো কোনোটিতে নির্মাণ কাজে ত্রুটির কারণে বৃষ্টির সময় পানি জমে থাকতে দেখা যায়। আবার অনেক উড়াল সেতুর ক্ষেত্রে দেখা যায় পানি নিষ্কাশনের পথটি ধূলাবালি ও আবর্জনা দ্বারা বন্ধ হওয়ার কারণে বৃষ্টি পরবর্তী সহজে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হয়। এসব উড়াল সেতুর প্রতিটির দুপাশেই দীর্ঘদিন যাবৎ ধূলাবালি ও ময়লা-আবর্জনা জমে থাকার কারণে অনেকটা অবিশ্বাস্য হলেও ঘাস, গুল্ম ও শ্যাওলার উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায়।
ঢাকা শহরের অভ্যন্তরস্থ সড়কসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওপর ন্যস্ত। উভয় করপোরেশনের অগণিত পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে প্রতিদিন সকালে পরিচ্ছন্নতার কাজে নিমগ্ন দেখা যায় যদিও এ পরিচ্ছন্নতার কাজ ভোর রাত অথবা সূর্যোদয়ের পূর্বে সম্পন্ন করার কথা। পৃথিবীর সর্বত্র বিভিন্ন শহরস্থ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় জনমানুষের অস্বস্তি নিরসনে সূর্যোদয়ের পূর্বেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ সমাধা করা হয়। আমাদের দেশে শুধু ঢাকা শহর নয় অন্যান্য শহরেও সড়ক পরিচ্ছন্নতার কাজ এবং শহরের নির্ধারিত স্থান হতে বর্জ্য অপসারণের কাজ সূর্যোদয়ের পরক্ষণে অনেকক্ষেত্রে দুপুর অবধিও চলে। উভয় সিটি করপোরেশন তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব যে যথাযথভাবে প্রতিপালনে অক্ষম তা বিভিন্ন সড়কের দুধারে ময়লা-আবর্জনা ও কাদার উপস্থিতি এবং আবর্জনা রাখার নির্ধারিত স্থানের চতুর্পাশে আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এবং আবর্জনাস্থল হতে নির্গত উৎকট দুর্গন্ধ হতে নগরবাসী অনুধাবনে সক্ষম।
ঢাকা শহরের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অগণিত কর্মচারী যারা সার্বক্ষণিক গাড়ির সুবিধা হতে বঞ্চিত তাদেরকে দূরত্বভেদে নিজ উদ্যোগে নির্ধারিত সময়ে অফিসে উপস্থিত হওয়ার লক্ষ্যে নিজ নিজ ঘর হতে বের হতে হয়। অনেকের ক্ষেত্রে দূরত্বের কারণে অফিস শুরুর নির্ধারিত সময়ের ৩ হতে ৪ ঘণ্টা পূর্বে ঘর হতে প্রস্থান করে নির্দিষ্ট স্থানে স্টাফ বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এরূপ অনেক অফিসগামী পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের কর্মকালীন সড়ক অতিক্রমকালে অসহনীয় ও দূর্বিষহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। এতে তাদের মুখম-ল, চুল, পোশাকপরিচ্ছদ ধূলোয় আবৃত হয়ে যায়। এ ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি পরবর্তী সুস্থ শরীরে অফিস করা কষ্টকর হলেও সমস্যাটির নিরসন না হওয়ার কারণে তাদেরকে এটিকে মেনে নিয়েই অফিসের কাজ সমাধা করে বাড়ি ফিরতে হয়।
ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন শহরের বহিরস্থ মহাসড়ক এবং তদস্থিত সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও জনপথ বিভাগের ওপর অর্পিত হলেও মহাসড়কে ফুটপাত না থাকার কারণে সার্বক্ষণিক যান চলাচল সচল থাকায় সড়কে কোনো ধরনের ময়লা বা আবর্জনা স্থিত হতে পারে না কিন্তু সেতুর ক্ষেত্রে ফুটপাত ও রেলিং থাকায় তা তথায় স্থিত হয়। আমাদের দেশের মহাসড়কস্থ বিভিন্ন সেতু অতিক্রম করার সময় এর দুপাশে যেভাবে ময়লা-আবর্জনা, ঘাস ও গুল্মের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তাতে অনেকের মনে প্রশ্নের উদয় হয় এগুলো দেখভাল করার কেউ কি নেই। বাস্তবতা হলো কেউ থাকলেও দায়িত্ব পালন বিষয়ে সচেতনতার অভাবে প্রতিকারবিহীনভাবে সমস্যাটির সুরাহা না হয়ে তা বিদ্যমান থেকে যাচ্ছে।
সরকারের নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ যখন তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনে অপারগ হয় তখন অনেক দেশের ক্ষেত্রেই দেখা যায় জনদুর্গতি ও জনদুর্ভোগ লাঘবে সাধারণ জনমানুষের মধ্য হতে কতিপয় সচেতন, উদ্যোগী, উদ্যমী, সাহসী ব্যক্তি মানবিকতা ও বিবেকবোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে নিজ প্রচেষ্টায় স্বেচ্ছাশ্রমে দায়িত্বটি কাঁধে নিয়ে তা সমাপন পরবর্তী দেশ ও সমাজের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেন। দেশে পরিবেশ রক্ষা, নদী বাঁচাও প্রভৃতি বিষয়ে মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ ইত্যাদি হলেও ইতোপূর্বে এসব কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী কোনো সমাজসচেতন ব্যক্তিকে নিজ উদ্যোগে ও স্বেচ্চাশ্রমে জনদুর্ভোগ লাঘবে ময়লা-আবর্জনা অপসারণের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
আমাদের দেশসহ পৃথিবীর সর্বত্র যারা রাজনীতি করেন তাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে জনসেবা এবং সমাজ ও দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি। অন্যান্য দেশের রাজনীতিবিদরা সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে সফল হলেও আমাদের রাজনীতিবিদরা কতটুকু সফল সে বিষয়ে এ দেশের সাধারণ জনমানুষ সম্যক অবহিত। রাজনীতিবিদরা যেমন পেশাজীবী আমাদের দেশে অনুরূপ অনেক পেশাজীবী রয়েছে। রাজনীতিবিদদের ন্যায় প্রত্যেক পেশাজীবীর প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলোÑ মানবসেবা এবং এর পাশাপাশি দেশ ও সমাজের উন্নয়ন। যেকোনো কর্তৃপক্ষ তার জন্য নির্ধারিত কর্মসম্পাদনে ব্যর্থ হলে এর দায়ভার বিশেষত কর্তৃপক্ষের শীর্ষ পদধারীর ওপর বর্তায়। আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী দূরের অনেক কিছু দেখলেও তার নিজ শহরের উড়াল সেতু, সেতু ও সড়কের দুধারের ময়লা-আবর্জনা তার দৃষ্টিতে আসে না। দেশের যেকোনো পেশাজীবী সংগঠনের সম্মিলিত চেষ্টার পরিবর্তে একটি পেশাজীবী সংগঠনের একজন একক ব্যক্তির চেষ্টা অনেকের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হতে পারে।
সম্প্রতি চ্যানেল আই-এ কর্মরত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাজহারুল হক মান্না মোহাম্মপুরস্থ বছিলা সেতুর দুপাশে ময়লা-আবর্জনার উপস্থিতি প্রত্যক্ষ পরবর্তী অত্যন্ত ব্যথিত ও মর্মাহত হয়ে স্ব উদ্যোগে তা অপসারণের এক ব্যতিক্রমধর্মী অভিযানের ঘোষণা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তার ফেসবুকে পোস্ট দেন। মান্না প্রদত্ত পোস্ট হতে জানা যায় তার অভিযানটির নাম ‘বছিলা ব্রিজ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান’। পোস্টে বলা হয় অভিযানটি পরিচালনার সময়কাল ১৭ মার্চ, শুক্রবার, ভোর সাড়ে ৬টা হতে শুরু হয়ে ময়লা-আবর্জনা অপসারণ শেষ হওয়া অবধি। তিনি তার পোস্টে যেকোনো নাগরিককে তার এ অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে তার ডাকে অনেকে সাড়া দিয়ে অভিযানে অংশগ্রহণের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। মান্নার এ অভিযানটি সফলভাবে সমাপ্ত হলে তা আমাদের দেশের জন্য একটি উদাহরণ সৃষ্টি করবে এবং ভবিষ্যতে কর্র্তৃপক্ষের ব্যর্থতায় যে সকল উড়াল সেতু, সেতু ও সড়ক হতে ময়লা-আবর্জনা যথারীতি অপসারণ করা হয় না সেগুলো হতে অপসারণে তার মতো অনেকেই উদ্যোগী হবেন। যেকোনো কর্র্তৃপক্ষের ব্যর্থতায় সাধারণ জনমানুষের মধ্য হতে যখন যেকোনো সচেতন মানুষের উদ্যোগে এ ধরনের মহতী কাজ সম্পন্ন হয় তখন তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তা আছে কি নেই সে প্রশ্নে বিতর্কের জন্ম দেয়।
সম্পাদনা: আশিক রহমান