ইন্টার্ন চিকিৎসকদের আন্দোলন : প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
ডা. মো. তাজুল ইসলাম
এক. বগুড়ায় ইন্টার্ন ডাক্তারদের আক্রোশমূলক শাস্তি প্রদান ছিল ডাক্তার সমাজের জন্য সাপে বর বা আশীর্বাদ। কেননা স্বতঃস্ফূর্ত এ রকম আন্দোলন আদৌ হতো কিনা সন্দেহ, যদি না অহঙ্কারে দর্পিত মন্ত্রণালয় মৌচাকে ঢিল (তরুণ ডাক্তার) না মারা হতো। ডাক্তার সমাজের যে যৎসামান্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ছিল তা একে একে হরণ করা হয়েছে, মানসম্মান ধূলায় লুটিয়ে দেওয়া হয়েছে কিন্তু তারা নির্বিকার। তাদের উপর অবিরাম আক্রমণ হচ্ছে, ফৌজদারি আইনে আসামি বানানোর আইন হচ্ছে, তৃতীয় গ্রেডের উপরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু বিএমএ শুধু কৌশলী মৌখিক বিবৃতির মধ্যে সীমিত। নিজেদের অধিকার আদায় দূরে থাক, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ও আন্দোলন হবে, অবস্থা দেখে তেমন আশা অনেকেই ছেড়ে দিয়েছিল। বাস্তবতা হচ্ছে নব্বইয়ের পর ক্রমশ সকল পেশাজীবী সংগঠনই, যখন যে সরকার থাকে সে সরকারের ‘মনোনীত’ সংগঠন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ভয়ে থাকে ওই উপরিমহল কখন নাকচ হয়, বিরক্ত হয় বা না জানি ক্ষেপে যায়। আর কিছু আছে যারা নানাবিধ লোভনীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার লোভে চাটুকারিতার প্রতিযোগিতায় নামে। তাই সব পেশাজীবী সংগঠনই (তা এখন বা পূর্বেকার হোক) তাদের সাধারণ সদস্যদের দাবি নিয়ে তেমন জোরাল কোনো আন্দোলন করছে না বা করতে চায় না। (সাগর-রুনী হত্যা আন্দোলন একসময় কিভাবে ভেস্তে যায় তা আমরা জানি)।
এই তিক্ত বাস্তবতার কারণে ডাক্তারদের বর্তমান শোচনীয় অবস্থায় কেন্দ্রীয়ভাবে জোরাল আন্দোলন হবে এটা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। ৫২, ৬২, ৬৯, ৭১, ৯০-তে এ দেশের তরুণরাই সামনের কাতারে ছিল। এবারও আশার আলো ছিল, তরুণ ডাক্তাররা। নেতাহীন, দিকনির্দেশনাবিহীন, ক্ষ্যাপাটে আন্দোলন করতে পারে শুধু টগবগে তরুণরা এবং তাই তাদের শাস্তির আদেশ ছিল ডাক্তার সমাজের জন্য সাপেবর। একটি স্থানীয়, ক্ষুদ্র ঘটনাকে ইচ্ছাকৃতভাবে জাতীয় ইস্যু করা হয়েছে। অনেকটা সুয়োমোটোভাবে অতি উচ্চ অবস্থান থেকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা হয়েছে, যা বড়জোর ওই হাসপাতালের পরিচালক পর্যায়ে মীমাংসা করে ফেলার কথা।
জিম্মি করে আন্দোলন ও আইন নিজের হাতে তোলার অভিযোগ উঠেছে। পৃথিবীতে এমন কোনো আন্দোলন কি সফল হয়েছে, যা কাউকে না কাউকে জিম্মি না করে করা হয়েছে? জিম্মি করার পরও কি দাবি আদায় সবসময় করা যায়? অন্য কি পথ খোলা? আলোচনা? মানববন্ধন? যারা চায় এ আন্দোলন সফল না হোক তারাই এ খোড়া যুক্তি দেবে। সবচেয়ে কম ক্ষতিকর আন্দোলন হচ্ছে নিজ দায়িত্ব থেকে বিরত থাকা (মন্ত্রী শাজাহান খানের ভাষায় স্বেচ্ছা অবসর)। তা না হলে রাস্তায় নেমে ভাঙচুর করবে? এই কর্মবিরতি প্রত্যেক পেশাজীবীর অধিকার। কয়েক মাস আগে লন্ডনে ডাক্তাররা সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমেছিল বেতন বাড়ানোর জন্য। সেখানকার সংবাদপত্র বা বিচারবিভাগ একে জিম্মি বা বেআইনি কিছুই বলেনি। আর আমরা বেতন বাড়ানোর আন্দোলন করলে তো সংবাদমাধ্যম একে মামা বাড়ির আবদার বলে উপহাস করত।
দ্বিতীয়ত আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অভিযোগ। সারাদেশে সবাই সুবোধ বালকের মতো আইন মেনে চলেন, শুধু ডাক্তাররাই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। কোনো তরুণ ডাক্তার কোনো ভার্সিটিতে গিয়ে সেখানকার কোনো তরুণীকে ইভটিজিং করলে সে ডাক্তার সেখান থেকে হাড়গোড় অক্ষত অবস্থায় ফিরতে পারবে কি? সংসদে মারামারি হয় না? আদালতে বিচারকের দরজায় লাথি মারা হয়নি? কারা এসব করে? তারা কি আইনের লোক নয়? তারা কি অল্প বয়সী তরুণ? তবু এটি মেনে নেব সরাসরি মার না দিয়ে ওই ছেলেকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করলে, ওই তরুণ ডাক্তাররা বুদ্ধিমানের কাজ করতেন। কিন্তু বুদ্ধি সবসময় কাজ করে কি?
আন্দোলন সফল না বিফল? আগেই বলেছি দেশের সকল ডাক্তাররা বঞ্চনা, অপমানে অতিষ্ঠ। তারা একটি প্রবল ও সফল আন্দোলনের স্বপ্ন দেখছে বহুদিন যাবৎ। কিন্তু আন্দোলন তো হয়, কোনো না কোনো নেতৃত্ব দিয়ে (আমাদের মতো ছাপোষা লোকেরা লিখতে পারি, স্বপ্ন দেখতে ও দেখাতে পারি, কিন্তু আন্দোলন করতে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন বা প্রয়োজনের তাগিদে গড়ে ওঠা নতুন তেজি, বেগবান কোনো প্লাটফর্ম অত্যাবশ্যক)। প্রশাসন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়াতে, ইন্টার্নদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যাওয়াতে আমরা একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন জেগে উঠতে দেখলাম। তাই আশাহত সকল চিকিৎসক নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করল, এই আন্দোলন দিয়েই এবার অন্তত আমাদের সব দাবি আদায় করে ঘরে ফিরব।
তবে বাস্তবতা কি? শক্তিশালী, আপোসহীন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব না থাকলে, প্রচ- বৈরী আমলাতন্ত্র, সংবাদমাধ্যম ও সরকারকে বোঝানো কি এত সহজ? কিছুদিন আগেই কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয়সহ পে-স্কেল বিরোধী আন্দোলনে বিএমএসহ পুরো প্রকৃতি কি ঘোড়ার ডিম অর্জন করেছিল? কেন করতে পারেনি? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের মর্যাদা ঠিকই আদায় করে নিয়েছে। ডাক্তারদের কি সে রকম শক্ত মেরুদ- ও মর্যাদাবোধ আছে যে তারা মর্যাদা আদায় করে নেবে? আর ইন্টার্নদের কি দায় পড়েছে যে তারা ডাক্তার সমাজের সকল দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সরকারের রোষানলে নিজেদের সপে দিয়ে হয়রানির সম্মুখীন হবে? তখন তাদের বাঁচাতে কে এগিয়ে আসবে? তার পরেও আন্দোলনে যতটুকু অর্জিত হয়েছে একে খাটো করে দেখার উপায় নেই। মনে করার কারণ নেই প্রশাসন দয়া করে আপোস করেছে। কেননাÑ
পাঁচ. ডাক্তার বনাম বিএমএ-এর রয়েছে ঐতিহাসিক ও সফল আন্দোলনের ঐতিহ্য। এরশাদ সরকার হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ডাক্তারদের আন্দোলন কি। ডা. মিলনের আত্মাহুতি স্বৈরাচার পতনে নিয়ামক ভূমিকা রেখেছে। অতীতে বিএমএ ছিল সকল সরকারের জন্য আতঙ্কের ব্যাপার। যারা বলে জনগণকে জিম্মি করে আন্দোলন করা অনুচিত তারা ভালো করেই জানে, কোনো পেশাজীবীদের আন্দোলনে জনজীবনে কতটুকু প্রভাব পড়বে। সরকার ও ভালো করে জানে কারা ও কোন আন্দোলন গতি পাবে, সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় জানু রাজনীতিবিদ। উনি ‘হাওয়ার’ গতি বুঝতে ভুল করার কথা নয়। দক্ষতার সহিতই তিনি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য যা কিছু করার, যেভাবে করার তা করেছেন। তাছাড়া আমার ধারণা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছেন। কেননা তিনি গণমানুষের সেন্টিমেন্ট সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারেন ও সেটিকে সম্মান করেন।
(তবে ছাত্রলীগের সহায়তা ছাড়া আমাদের নেতাদের সরব ও প্রকাশ্য তত্ত্বাবধানে ফয়সালাটা হলে উনারা যেমন সম্মানিত হতেন, তেমনি মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে ডাক্তার সমাজের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেত। ব্যাপারটি উইন উইন সিচুয়েশন হলে ভালো হতো। প্রশাসন ডাক্তার কমিউনিটিকে গুরুত্ব দেয়, মর্যাদা দেয়, নিছক দয়া করে না, আমরা এটি দেখতে চেয়েছিলাম)। তদুপরি আন্দোলন সফল না ব্যর্থ তা মূল্যায়নে তরুণ ডাক্তার ভাইদের বলছিÑ সফলতা মানে নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যে পৌঁছানো নয়, সফলতা হচ্ছে সে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অবিরাম যাত্রা (জার্নি)। অনেকে বলবেন, এসব মন ভোলানো কথা। তাদের জন্য বলছি।
ডাক্তার সমাজ এতদিন শুধু প্রতিক্রিয়ামূলক আন্দোলন করেছে। তাদের যৎসামান্য যতটুকু ছিল প্রশাসন বিভিন্ন সময় সে অধিকারগুলোও ছিনিয়ে নিতো। আমরা কেবল প্রতিক্রিয়া করে সে ছিনিয়ে নেওয়া অধিকার বা সম্মান ফেরত পেতে চাইতাম। কখনো কখনো ছিটেফোঁটা কিছু ফেরত পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতাম। কিন্তু কখনো পেশা হিসেবে ডাক্তারদের উচ্চমর্যাদা, সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার যে কথা সেটি আদায়ে কোনো ইতিবাচক, প্রো-অ্যাক্টিভ আন্দোলন আমরা কখনো করিনি। স্বতন্ত্র বেতন স্কেল, ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সি, কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরসহ তথাকথিত ক্যাডার বাদ দিয়ে মর্যাদাসম্পন্ন স্বতন্ত্র অবস্থান, সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় আইন (যেমন বিচারকরা পেয়ে থাকেন) ইত্যাদি আদায়ে ইতিবাচক আন্দোলন আমরা কবে দেখব? হ্যাঁ স্বপ্ন যদি দেখুন এ রকম স্বপ্ন দেখুন, দুঃস্বপ্ন নয়। দুঃস্বপ্ন হচ্ছে যা সামান্য আছে সেখান থেকেও কিছু ছিনিয়ে নিলে, হারালে বা অপমান অপদস্ত হলে তাৎক্ষণিক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া করা। সেটি করতে হবে প্রাণের দায়ে। কিন্তু মর্যাদা, অধিকার অর্জন করতে হবে প্রো-অ্যাক্টিভ, লক্ষ্যাভিমুখী আন্দোলন দিয়ে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
লেখক: অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
সম্পাদনা: আশিক রহমান